সন্ধ্যা, দূর মফস্বল শহর:
আরিফের হাতে ধরা ল্যান্ডফোনের রিসিভারটা তখনও গরম। ডায়াল টোন বেজে চলেছে একঘেয়ে সুরে, কিন্তু আরিফের কানে তা পৌঁছাচ্ছে না। তার দৃষ্টি জানালার বাইরে, যেখানে ধূসর সন্ধ্যা নেমে আসছে শহরের ব্যস্ত রাজপথে। এক সপ্তাহ হলো—ঠিক গত বৃহস্পতিবার ভোরে—তার বড় দুলাভাই মারা গেছেন।
দূরের জেলায় একটি ফ্যাক্টরীর নতুন এইচআর এবং অ্যাডমিন বিভাগের দায়িত্বের ভার, কাজের চাপ, নতুন সেটআপ—এসবই ছিল না যাওয়ার বাহানা। কিন্তু আরিফের মনের গভীরে সে জানত, আসল কারণটা আরও জটিল। তার বড় বোন হাসনাহেনার সাথে তার দুলাভাইয়ের সম্পর্ক ছিল এক হিমশীতল মরুভূমির মতো, যেখানে ভালোবাসার কোনো মরুদ্যান ছিল না। আরিফের বোন জীবনের সবটুকু শক্তি দিয়ে লড়েছেন, টিউশনি করে, সেলাই করে, কখনো-সখনো উপোস থেকে তার তিন সন্তানকে মানুষ করেছেন।
ছেলেমেয়েরা এখন প্রতিষ্ঠিত—বড় ছেলে নামকরা একটি গার্মেন্টসের সুপারভাইজার, মেয়েটা হাইস্কুলের শিক্ষিকা, ছোট ছেলেটা মাস্টার্সের প্রস্তুতি নিচ্ছে আর চাকরির খোঁজ করছে। তাদের বাবার মৃত্যুতে তাদের চোখে জল ছিল, কিন্তু জলে কতটুকু ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা ছিল সে প্রশ্ন তোলা কোন মৃত্যের প্রতি হয়তো জুলুম করা। কারন বাবা বলতে যা বোঝায় সে অর্থে তারা তাকে কখনও পেয়েছে কিনা তার বড় স্বাক্ষ স্বয়ং আল্লাহ্ তায়ালা। আর সে জলে ভালোবাসা কেমন করে থাকবে? বাবা তো কোনোদিন তাদের কাছে বাবা ছিলেন না। তাদের জীবনে ‘বাবা’ শব্দটির একমাত্র অর্থ, একমাত্র প্রতিশব্দ ছিলেন তাদের মা—হাসনাহেনা।
আরিফ মাথা নিচু করে টেবিলে রাখা একটা ফাইল দেখতে চেষ্টা করলো, কিন্তু অক্ষরগুলো সব ঝাপসা হয়ে গেল। অফিসের লাইটগুলো হঠাৎ অসহ্য মনে হলো। সে নতুন দায়িত্ব নিয়ে এসেছে, তাকে শক্ত থাকতে হবে, মনোযোগ দিতে হবে।
কিন্তু মন মানছে না। সমস্ত হিসেব-নিকেশ, সমস্ত যুক্তিতর্ক ছাপিয়ে তার হৃদয়ে যেন এক অব্যক্ত যন্ত্রণা মোচড় দিয়ে উঠলো। “আমার যদি দুটো পাখা থাকত…”—এই চিন্তাটা একটি ভাঙা রেকর্ডের মতো তার মস্তিষ্কে বাজতে লাগল।
সে চোখ বন্ধ করলো। স্মৃতির পর্দা সরে গেল, ভেসে উঠলো পঁচিশ বছর আগের একটা দৃশ্য।
ফ্ল্যাশব্যাক: গ্রামের বাড়ি, এক শীতকাল
আরিফ তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে বছরখানেক। শীতকালে তাদের দুলাভাইয়ের গ্রামে ওয়াজ মাহফিল হতো। সেই রাতে দুলাভাই তাকে নিতে এসেছিল। হাটতে হাটতে এগল্প সেগল্প করতে করতে দুজন গিয়েছিল মাহফিলের মাঠে।
“আরিফ, তোর পছন্দের কী আছে বল তো,”—দুলাভাইয়ের হাসি মুখটা এখনও স্পষ্ট। পকেটে হাত ঢুকিয়ে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে দিয়েছিলেন। সেই পাঁচশ টাকা দিয়ে আরিফ মেলায় এয়ারগান দিয়ে বেলুন ফুটানো খেলা খেলত, মেলা থেকে কিনেছিল বাঁশির মতো দেখতে লাল রঙের একটা নলখাগড়া, গরম জিলাপি আর একটি চিনির তৈরি ঘোড়া।
দুলাভাই তাকে হাত ধরে নিয়ে যেতেন ওয়াজ শুনতে, যাতে ভিড়ে হারিয়ে না যায়। মাহফিলের ভিড়ের মধ্যে সে নিজেকে রাজার মতো অনুভব করেছিল। দুলাভাইয়ের মুখটা ছিল তার কাছে অনেক নির্ভরতার প্রতিক, নিরাপদ বিশ্বাসের আশ্রয়।
“আরিফ, তুই একদিন অনেক বড় হবি,” দুলাভাই কানে ফিসফিস করে বলেছিলেন, “ভালো করে লেখাপড়া করিস। আমার মতো অকর্মা যেন না হোস।”
সেই ভালোবাসা, সেই আশ্রয়টা ছিল খাঁটি। কিন্তু সেই ভালোবাসার আড়ালেই ছিল এক অন্য মানুষ—যে তার স্ত্রী হাসনাহেনাকে শুধু অবহেলাই করেনি, কষ্টও দিয়েছে। সেই কষ্টের দেয়ালই আরিফকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। বোনের প্রতি অবিচার দেখে সে তার প্রিয় দুলাভাইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। তার দুলাভাইও যেন এই দূরত্ব মেনে নিয়েছিলেন, সম্ভবত নিজের কৃতকর্মের অনুশোচনা থেকেই।
বর্তমান:
আরিফের চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো, টেবিলের কাঠের ওপর একটা গাঢ় চিহ্ন এঁকে দিল। সে তার বোনের কষ্টে অংশীদার হতে সম্পর্ক নষ্ট করেছিল, কিন্তু এখন যখন সেই কষ্ট-দাতা চলে গেছেন, তখন আরিফের মন হু হু করছে।
এটা কোনো শোক নয়, এটা এক অপরাধবোধ। না যেতে পারার অক্ষমতা। সেই ছোট্টবেলার প্রিয় মানুষটির শেষ মুখখানি দেখতে না পারার গভীর এক শূন্যতা। মনে হচ্ছে, তার জীবনের একটি পৃষ্ঠা, যদিও তা কালিমালিপ্ত, তবুও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেই পৃষ্ঠাটি আজ ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।
হঠাৎ আরিফের মনে হলো, এই পৃথিবীতে সে একা। তার বোন তার সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ত, তারা নতুন করে জীবন গুছিয়ে নেবে। দুলাভাইয়ের সাথে সম্পর্ক না থাকলেও, তাদের একটি নিজস্ব জগৎ ছিল। কিন্তু আরিফ… সে যেন মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।
তার দুলাভাইয়ের মৃত্যুতে হাসনাহেনা হয়তো মুক্তির নিশ্বাস ফেলবেন, অথবা গভীর শোকে পাথর হয়ে যাবেন, ছেলেমেয়েরা পাবে স্বস্তি কিম্বা বুকফাটা অব্যক্ত বেদনায় বিমুর্ষ্য। কিন্তু আরিফ? তার হৃদয়ে আজ কেবলই এক তীব্র হাহাকার, এক অব্যক্ত বেদনা।
সে উঠে দাঁড়ালো। কাঁধের উপর যেন এক পাহাড়ের ভার। এই পৃথিবীতে তার নিজের বলতে কেউ নেই। সে আজ ডানাভাঙা এক পাখি, যার ডানা থাকলেও সে উড়তে পারবে না। আর পাখা না থাকায় সে তার প্রিয় দুলাভাইয়ের মৃত মুখ দেখতেও যেতে পারলো না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরিফ জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। রাতের অন্ধকার আরও ঘন হয়েছে। সেই অন্ধকারে আরিফ কেবলই একাকী। সেই ছোটবেলার ভালোবাসার স্মৃতি এবং বর্তমানের তিক্ত বাস্তবতার মাঝে সে যেন চিরকালের জন্য আটকে গেছে। একাকীত্বের এই ভার নিয়েই তাকে ফিরতে হবে জীবনের রুটিনে, নতুন এইচআর অ্যান্ড অ্যাডমিন বিভাগের কঠিন দায়িত্বে। কিন্তু তার হৃদয়ের এই ক্ষত, এই শূন্যতা হয়তো কোনোদিনও পূরণ হবে না।
মন্তব্য করুন