shofiq.com

তোষামোদের মারাত্মক প্রভাবঃ কেন চাটুকারিতা ক্ষতিকর?

শত শত বছর ধরে তোষামোদ (Flattery) বা চাটুকারিতা মানব মিথস্ক্রিয়ার একটি অংশ। এটি প্রায়শই সুবিধা অর্জন, অন্যদের কারসাজি করা বা কেবল কিছু অগভীর সম্পর্ক বজায় রাখার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়।1 যদিও কয়েকটি মিষ্টি কথা শুরুতে নির্দোষ মনে হতে পারে, তবুও তোষামোদের এই কাজটি সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব কেন তোষামোদ ক্ষতিকর এবং একজন চাটুকারের প্ররোচনামূলক আকর্ষণের শিকার হওয়ার বিপদগুলি সম্পর্কে আলোকপাত করব।

১. মিথ্যা বৈধতা এবং কারসাজির ফাঁদ

তোষামোদ প্রায়শই অসৎ প্রশংসা এবং চাটুকারিতা নিয়ে গঠিত, যা মানুষকে কারসাজি (manipulate) এবং প্রতারণা করার জন্য তৈরি করা হয়। একজন চাটুকার ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের মাধ্যম হিসাবে লোভনীয়তা এবং প্রশংসা ব্যবহার করে—তা অন্যায় সুবিধা আদায় করা হোক, অযাচিত প্রশংসা লাভ করা হোক বা কারো দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া হোক। মানুষের বৈধতার আকাঙ্ক্ষার উপর ভরসা করে, চাটুকাররা বিশ্বাস এবং বন্ধুত্বের একটি বিভ্রম তৈরি করে, যার আড়ালে তারা তাদের লুকানো উদ্দেশ্য পূরণ করতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায়, তোষামোদকারীর উদ্দেশ্য থাকে সবসময় নিজেকে লাভবান করা, এবং যাকে তোষামোদ করা হচ্ছে তাকে একটি মিথ্যা নিরাপত্তা বোধে ডুবিয়ে রাখা।

২. আন্তরিক সম্পর্কের অবক্ষয়

যখন আন্তঃব্যক্তিক মিথস্ক্রিয়ায় তোষামোদ একটি অভ্যাসে পরিণত হয়, তখন এটি আন্তরিক সম্পর্কের ভিত্তি ক্ষয় করে ফেলে।2 যারা ক্রমাগত অন্যদের তোষামোদ করে, তারা সততার সাথে মতামত এবং গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া (constructive feedback) প্রকাশ করার ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকিতে থাকে। অনুমোদন পাওয়ার এবং খুশি করার আকাঙ্ক্ষা তখন আন্তরিকতা (authenticity)-র চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়, যার ফলস্বরূপ সত্যিকারের বোঝাপড়া এবং বিশ্বাসবিহীন অগভীর সংযোগ তৈরি হয়। তোষামোদে আন্তরিকতার অনুপস্থিতি পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে তৈরি অর্থপূর্ণ সম্পর্কের বৃদ্ধি ও বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। এমন সম্পর্ক কেবল স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যম হিসেবে টিকে থাকে।

৩. বিচারশক্তি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের দুর্বলতা

তোষামোদ বাস্তবতার উপলব্ধি বিকৃত করে বিচারশক্তিকে মেঘাচ্ছন্ন করে তোলে। যখন কেউ ক্রমাগত প্রশংসিত এবং তোষামোদিত হয়, তখন তারা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। তোষামোদের আকর্ষণ ব্যক্তিদের তাদের দুর্বলতাগুলির (weaknesses) প্রতি অন্ধ করে দিতে পারে এবং ব্যক্তিগত উন্নতির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা থেকে বিরত রাখতে পারে। ফলস্বরূপ, তারা এমন ব্যক্তিদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতে পারে যারা তাদের উন্নতি করার জন্য চ্যালেঞ্জ না করে কেবল তাদের অহংকারকে প্রশ্রয় দেয়। এই অবস্থায়, ব্যক্তির পক্ষে সঠিক সময়ে কঠিন বা অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে।

৪. ব্যক্তিগত উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি

তোষামোদ ব্যক্তিগত বৃদ্ধি এবং আত্ম-উন্নয়নকে ব্যাহত করে। ব্যক্তিগত বিকাশ এবং সাফল্য অর্জনের জন্য গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া, এমনকি সমালোচনামূলক হলেও, অপরিহার্য। একজন চাটুকার, তার নিজস্ব স্বার্থ দ্বারা চালিত হয়ে, খুব কমই সৎ মূল্যায়ন বা গঠনমূলক সমালোচনা সরবরাহ করে।3 ব্যক্তিদের তাদের দুর্বলতাগুলি থেকে আড়াল করার মাধ্যমে, তোষামোদ তাদের ভুল থেকে শেখার, উন্নতির ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করার এবং অবশেষে তাদের পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছানোর ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে।4 চাটুকারিতার ফলে ব্যক্তিটি নিজেকে ত্রুটিহীন ভাবতে শুরু করে এবং শেখার সুযোগ হারায়।

৫. বিশ্বাস এবং সততার পতন

তোষামোদের অভ্যাসগত ব্যবহার সমাজে বিশ্বাস এবং সততাকে (integrity) ক্ষুণ্ণ করে। যখন কেউ তোষামোদের প্রবণতার জন্য পরিচিত হন, তখন তার কথার বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পায়।5 অন্যরা তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করে, ফলে বিশ্বাসের ভিত্তিতে সত্যিকারের সম্পর্ক তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়ে।6 তোষামোদের কারণে সৃষ্ট এই আস্থার অবক্ষয় বৃহত্তর প্রভাব ফেলতে পারে, যা পেশাদার পরিবেশ, সামাজিক বৃত্ত এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের কাঠামোকেও প্রভাবিত করে। একটি সমাজে সততা ও আন্তরিকতার স্থান চাটুকারিতা দখল করলে সেখানে সত্যিকারের গুণাবলীর কদর থাকে না।

উপসংহার

তোষামোদ প্রাথমিকভাবে আকর্ষণীয় এবং নিরীহ মনে হলেও, এর ক্ষতিকর প্রভাব সময়ের সাথে সাথে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তোষামোদের ব্যাপক প্রকৃতি আন্তরিক সম্পর্ককে ক্ষয় করে, বিচারশক্তিকে বিকৃত করে, ব্যক্তিগত বিকাশকে বাধা দেয় এবং বিশ্বাস ও সততাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ক্ষতিকর প্রভাবগুলি চিনতে পারা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি যাতে আমরা আন্তরিকতা গড়ে তুলতে পারি, গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করতে পারি এবং বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে অর্থপূর্ণ সংযোগ তৈরি করতে পারি। সতর্ক থাকার মাধ্যমে এবং শূন্য প্রশংসার চেয়ে আন্তরিকতাকে বেশি মূল্য দেওয়ার মাধ্যমে, আমরা তোষামোদের বিপজ্জনক পথ পেরিয়ে স্বাস্থ্যকর ও আরও সন্তোষজনক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি।

মোঃ শফিকুল ইসলাম প্রিয়

এই প্রকাশনাটির সর্বস্বত্ত লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত। এই প্রকাশনার আংশিক বা সম্পুণাংশ অন্য যেকোন মিডিয়াতে লেখকের নামে ছাড়া অন্য কারও নামে প্রকাশ করা কপিরাইট আইন এ দন্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গন্য হবে।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমুহ

    Recent Comments