হাসপাতালের রাত্রি

হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে অপলক তাকিয়ে আছে বারান্দায় সামনের কাঁঠাল গাছের পাতাগুলোর দিকে সাদরুল মিয়া। যেন এই প্রথম কাঁঠাল পাতা দেখছে সে। কাঁঠালের পাতায় পাতায় জড়িয়ে আছে যেন জীবনের এক অন্য রকম হিসাব। কিছুটা যেন নিজের জীবনের বা বয়সের প্রতিচ্ছবি। প্রকৃতিতে পাতা ঝরার বাতাস লাগা শুরা হয়েছে সবে মাত্র। কাঠালের পাতাগুলোও তা থেকে ব্যতিক্রম কিছু না। পড়ন্ত বিকালের তীর্যক সূর্যের আলোক রশ্মি কাঁঠাল গাছের বৃদ্ধ পাতাগুলোকে আরও রঙ্গিন করে তুলেছে। হাসপাতালের পয়েন্টিং করা সিরামিক ইটের দেওয়ালের কর্নিশে বসে একটি চড়ুই পাখি আনমনা রৌদ্র স্নান করছে অথবা তার একাকিত্বের কথা রৌদ্রের কাছে, পৃথীবির শূন্যতার কাছে জানান দিচ্ছে।

হাসপাতালের ওয়ার্ডের বেডে ছিট না পাওয়ার কারনে তার সহকর্মীগন বাধ্য হয়ে বারান্দার বেডে ভর্তি করেছে সাদরুল মিয়াকে। দুই দিনের ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালে উঠেছে সাদরুল মিয়া। আবুও তো আলহামদুলিল্লাহ যে বারান্দায় হলেও চিকিৎসা টা নিতে পারতেছে। তা না হলে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে বিভাগীয় শহরে ছুটতে হত। তারপর আবার সিএনজি পাওয়া নিয়ে ঝামেলা হত হয়ত অত রাতে।

রাত তখন একটা বাজে। সাদরুল মিয়া আর চাপ নিতে পারে না। গতরাত তিনটার পর থেকে শুরু হয়ে এপর্যন্ত প্রায় বিশ বারেরও বেশি টয়লেটে গেছে সে। তারপর আবার মাঝে মাঝে কাঁপুনি দিয়ে দিয়ে জ্বর আসছে। শরিরে এতটুকু শক্তি নেই যে ওয়াশ রুমে যাবে। শরিরের ডান দিকে খিঁচুন উঠে গেছে। ওর সহকর্মীদেরকে ডাক দেয় সাদরুল মিয়া। তারা এক মুহূর্ত দেরি না করে বাইক নিয়ে হাসপাতালে চলে আসে।

সাদরুল মিয়া একটি কোম্পানিতে বিজনেস প্লানিং ডিপার্টমেন্ট এ জব করে। সাদরুল মিয়াদের কোম্পানী সরকারি একটি প্রজেক্টে ল্যান্ড লীজ নিয়েছে তাদের কোম্পানির নিজস্ব প্রডাক্টের প্রডাকশন ফ্যাক্টারী করার জন্য।

এখানকার কমেনিকেশন এত গ্যাপ তা বলবার মত নয়। দৈনন্দিন কেনাকাটার জন্যও সেই পাঁচ কিলোমিটার দূরের বাজারে যেতে হয়। তা-ও আবার সব কিছু পাওয়া যায় এমন না। তরকারি খাবার কাঁচা কলা বা আনাজ কলা কোনো বাজার এ পাওয়া যায় না এমনটি ভাবতে পারেন! শুধু এমন নয় একদিন সাদরুল মিয়ার এক কলিগ অ্যালবেন ডিএস ট্যাবলেট খুজতে খুজতে বাজারের সব ফার্মেসী শেষ তখন তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে সিভিট খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন কিন্তু তাতেও ব্যর্থ মনোরথে ফিরতে বাধ্য হলেন।

সাদরুল মিয়ার পাতলা পায়খানা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী নার্সেরা স্যালাইনের পর স্যালাইন, ইনজেকশন এর পর ইনজেকশন দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু সাদরুল মিয়ার পাতলা পায়খানা কোনো ব্যবস্থাপত্র মানে না। সাদরুল মিয়া আম্মাই ইজিবুল দোয়া পাঠ করে আর ভাবে এই ই বুঝি শেষ যাত্রা। আর হয়তোবা স্ত্রী কন্যা মা কিম্বা স্বজনদের সাথে আর দেখা হবে না। সাদরুল মিয়া জীবনে যত ইচ্ছাকৃত অনা ইচ্ছাকৃত পাপের কর্ম করেছেন তার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং যত ভালো কাজ করেছেন তার দোহাই দিয়ে আল্লাহর নিকট সুস্থতার আবেদন জানাইতে থাকেন। যদিও সাদরুল মিয়া তার জানা মতে কোন ব্যাক্তির উপকার করতে না পারলে ক্ষতি করার চেষ্টা করেন না তবুও তিনি আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন।

দায়িত্বরত ডাক্তার সাহেবা রাউন্ডে এসে সাদরুল মিয়ার নিকট জানতে চাইলেন, এখন কেমন আছেন বাবা আপনি?

না মা, পায়খানা তো নিয়ন্ত্রণে আসছে না।  সাদরুল মিয়ার জবাব।

সবুজ রঙের দুইটা ক্যাপসুল দিয়েছে সেটা খেয়েছেন?  ডাক্তারের প্রশ্ন।

হ্যাঁ খেয়েছি। সেটা খাওয়ার পরেও দুই বার গেছি। আর পেটের ভিতর অসম্ভব ব্যাথা। মনে হচ্ছে কেউ কাপড় নিংড়ানোর মত আমার নাড়িভুড়ি গুলো নিংড়াইতেছে।

আচ্ছা বুঝচ্ছি।

ডাক্তার সাহেবা নার্স দেরকে পূর্বের চিকিৎসা রিপিট করতে বলে চলে গেলেন। যাবার সময় সাদরুল মিয়াকে আশস্ত করে গেলেন একটু সময় লাগবে।

এদিকে সাদরুল মিয়া তো অনেক হতাশ এবং অসহায় বোধ করতে থাকে। গতদিন থেকে এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলায়ে ১১ টা স্যালাইন নেওয়া হয়েছে সাথে তিন বেলা দুইটা দুইটা করে ইনজেকশন তো রয়েছেই কিন্তু কোনোভাবেই সাদরুল মিয়ার পাতলা পায়খানা থামে না। নার্সরা কেনোলার ভিতর দুইটা ইনজেকশন ও তিন ধরনের তিনটা স্যালাইন স্যান্ডে ঝুলিয়ে সাদরুল মিয়ার সাথে থাকা সহকর্মীকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল।

সাদরুল মিয়ার হোয়াটস অ্যাপে রিং বেজে উঠল। রিসিভ করার পর ওপাস থেকে সালাম জানিয়ে শারিরের হালহকিকত জানতে চান সাদরুল মিয়ার সহধর্মিণী। সাদরুল মিয়া জবাব দেন আলহামদুলিল্লাহ কুল্লি হাল। আল্লাহ যে অবস্থায় রেখেছেন শুকরিয়া। এর চেয়ে অবস্থা আরও খারাপ হতেও তো পারতো। কিম্বা অন্য কিছু…

তোমাকে অনেক বার আমি নিষেধ করেছি এধরনের কথা না বলতে তারপরেও..

আল্লাহর যদি নেওয়ার ইচ্ছা হয় তাহলে আমি বললেও কি আর না বললে কি সাদরুল মিয়া তার ওয়াইফের মুখের কথা শেষ হওয়ায় আগেই জবাব দেয়। যাইহোক তুমি এধরনের কথা আর কখনই বলবা না। আর আমি আগামীকাল চলে আসিতেছি তোমার পাশে এখন আমার থাকা দরকার। সাদরুল মিয়া বাঁধা দিয়ে বলে, না কোনোভাবেই না কোন মতেই না। ছোট মেয়ের পরীক্ষা শুরু হবে তুমি চলে এলে ওর পরীক্ষার কি হবে? মেয়ে না হয় এবছর পরীক্ষা না দিবে তবুও। তবুও তুমি আসবে না কারন রাস্তার অবস্থা ভালো না। চারদিক হরতাল অবরোধ হট্টগোল। এ-র ভিতর তুমি কোনভাবেই রাস্তায় উঠবে না। এটা তোমার স্বামীর আদেশ। শোন তোমার আদেশ আমার শিরোধার্য কিন্তু তোমার এ অবস্থায় যদি আমি না থাকি তাহলে আমার স্ত্রী জীবনের কি মূল্য আছে বল। তুমি বুঝতেছো না কেনো দেশের এ পরিস্থিতিতে তোমাদেরকে আমি বাড়ির বাইরে বের হবার অনুমতি দিতে পারি না। তাছাড়া মেয়েদের কথাটা অন্তত ভাবো। ও প্রান্ত থেকে এবার কান্নার শব্দ শোনা যায়। সাদরুল মিয়া কিং কর্তব্য বিমূঢ় হয়ে থাকে কিছু ভাবতেও পারে না কিছু বলতেও না।

দুরে একদল শিয়াল হুক্কাহুয়া ডেকে উঠে। হাসপাতালের সামনের কাঠাঁল গাছের পাতার ফাকে কোন এক নাম না জানা পাখি ডানা ঝাপটে উঠে। আকাশে চাঁদের কিরণে হাসপাতালের আড়াল থেকে সামনে তৃভুজাকৃতি আলো ফেলেছে। সেই আলোই ওপাশের বারান্দার পিলারে লেগে এক অশরীরী বস্তুর মত দেখায়। অশরীরী বস্তুর ছায়া দেখে ভয় পাওয়ার চেয়ে সাদরুল মিয়ার পেটের ব্যাথাই যেন বড় ভয়ের কারন। সাদরুল মিয়া আল্লাহ্ রাসুলের নাম পাক পাঞ্জাতনের নাম আহলে বাইয়েতের নাম মাওলা আলীর নাম নাদে আলী দোয়া আয়াতুল কুরসি সুরা ইয়াসিন পড়তে থাকে।

হাসপালের বারান্দা গলে যখন সাদরুল মিয়ার শরিরে রৌদ্র এসে লাগে তখন তার ঘুম ভাঙ্গে। সারারাত না ঘুমানোর ক্লান্তি আর ডায়রিয়ার ধকল সাদরুল মিয়াকে যেন বিধ্বস্ত করে তুলেছে।

মোঃ শফিকুল ইসলাম প্রিয়

এই প্রকাশনাটির সর্বস্বত্ত লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত। এই প্রকাশনার আংশিক বা সম্পুণাংশ অন্য যেকোন মিডিয়াতে লেখকের নামে ছাড়া অন্য কারও নামে প্রকাশ করা কপিরাইট আইন এ দন্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গন্য হবে।...

মন্তব্য করুন

error: কন্টেন্ট কপি এবং পেস্ট protected!!