দ্বিতীয় পর্ব-
১। ‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ (প্রধানত পাপপ্রবণ নাফস্)
এটি নাফস্ এর সবচেয়ে নিম্ন স্তর এবং এমন একটি আত্মাকে বোঝায় যা পাপের দিকে প্ররোচিত করে। এটি ভিত্তিগত আকাঙ্ক্ষার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় এবং অবাধ্যতা ও ভোগবিলাসিতার দিকে ঝুঁকে থাকে। কুরআনে ‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ এর উল্লেখ রয়েছেঃ
اِنَّ النَّفۡسَ لَاَمَّارَۃٌۢ بِالسُّوۡٓءِ اِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّیۡ
“নিশ্চয়ই, নাফস্ সবসময় পাপের দিকে প্ররোচিত করে, তবে যাদের প্রতি আমার রব রহম করেছেন তারা ব্যতিক্রম।” (সূরা ইউসুফ, ১২:৫৩)
এই পর্যায়ে, একজন ব্যক্তি তাদের অহং এবং পার্থিব আকাঙ্ক্ষার দ্বারা প্রভাবিত হয়। তারা প্রধানত শারীরিক সন্তুষ্টি, ক্ষমতা এবং স্বীকৃতির প্রয়োজন দ্বারা চালিত হয়। এই স্তরে সংগ্রাম অত্যন্ত তীব্র, কারণ নাফস্ নিজেকে পরিশুদ্ধ করা বা নিয়ন্ত্রণের অধীনে আনার যেকোন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে।
২. ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’ (ভ্রান্তি সংশোধনকারী নাফস্)
এটি নাফস্ এর দ্বিতীয় স্তর এবং এটি একটি উচ্চতর সচেতনতার অবস্থাকে বোঝায়। এটি এমন আত্মার কথা বলে যা তার ভুলের জন্য নিজেকে তিরস্কার করে এবং ভ্রান্তি স্বীকার করে। ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’ সহ একজন ব্যক্তি তার ভুল বুঝতে পারে, তার পাপের জন্য অনুশোচনা করে এবং নিয়মিত তার আচরণকে সংশোধন করার চেষ্টা করে। কুরআনে এই স্তরের আত্মার উল্লেখ রয়েছেঃ
وَ لَاۤ اُقۡسِمُ بِالنَّفۡسِ اللَّوَّامَۃِ ؕ﴿۲﴾
“আমি শপথ করছি ভ্রান্তি সংশোধনকারী নাফসের।” (সূরা আল-কিয়ামাহ, ৭৫:২)
এই স্তরে, একজন ব্যক্তি যখন ভুল করে তখন অপরাধবোধ এবং লজ্জা অনুভব করে। নাফস্ যথেষ্ট সচেতনতা বিকাশ করেছে যাতে এটি সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হলে তা বুঝতে পারে। এখানে ইচ্ছা এবং বিবেকের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রবল, তবে ব্যক্তি ধার্মিকতার পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে আত্মা আরও বেশি বিজয় অর্জন করতে থাকে।
৩। ‘নাফস্ আল-মুতমাইন্নাহ’ (প্রশান্ত আত্মা)
অন্তিম এবং সর্বোচ্চ স্তর হলো ‘নাফস্ আল-মুতমাইন্নাহ’, প্রশান্ত আত্মা। এই আত্মা তার ভিত্তিগত আকাঙ্ক্ষাগুলোকে অতিক্রম করেছে এবং আল্লাহর স্মরণ ও আত্মসমর্পণে প্রশান্তি পেয়েছে। এটি আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট এবং ইবাদতে প্রশান্তি লাভ করে। কুরআনে এই আত্মাকে এমন আত্মা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যাকে জান্নাতে প্রবেশের জন্য ডাকা হবেঃ
یٰۤاَیَّتُهَا النَّفۡسُ الۡمُطۡمَئِنَّۃُ ﴿٭ۖ۲۷﴾
ارۡجِعِیۡۤ اِلٰی رَبِّكِ رَاضِیَۃً مَّرۡضِیَّۃً ﴿ۚ۲۸﴾
فَادۡخُلِیۡ فِیۡ عِبٰدِیۡ ﴿ۙ۲۹﴾
وَ ادۡخُلِیۡ جَنَّتِیۡ ﴿۳۰﴾
“হে প্রশান্ত আত্মা! তোমার রবের কাছে ফিরে এসো, সন্তুষ্ট এবং সন্তোষজনক অবস্থায়। আমার বান্দাদের মধ্যে প্রবেশ করো, এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।” (সূরা আল-ফজর, ৮৯:২৭-৩০)
‘নাফস্ আল-মুতমাইন্নাহ’ আধ্যাত্মিকভাবে এক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় পৌঁছেছে। এই অবস্থায় ব্যক্তির হৃদয় পার্থিব বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত এবং পুরোপুরি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিমগ্ন থাকে। বিশ্বাসীর যাত্রার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো তার নাফস্ পরিশুদ্ধ করে এই শান্তি এবং সন্তুষ্টির স্তরে পৌঁছানো।
এই তিনটি নাফস্ স্তরের মধ্যে পার্থক্য বুঝে আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক যাত্রায় কোথায় আছি তা নির্ধারণ করতে পারি এবং আল্লাহর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণের উচ্চতর অবস্থায় পৌঁছানোর জন্য কাজ করতে পারি। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আমরা কুরআন এবং হাদীস কীভাবে ‘‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং আমাদের আত্মাকে ‘নাফস্ আল-মুতমাইন্নাহ’ পর্যায়ে উন্নীত করতে গাইড করে, তা বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করব ইনশাআল্লাহ্।
নাফস্ কে অতিক্রম করার বা নিয়ন্ত্রণে রাখার যাত্রা একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এটি ধৈর্য, অধ্যবসায় ও সঠিক জ্ঞান ও প্রয়োগের প্রয়োজন। তবে, এই অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।
অধ্যায় ২। তিন ধরনের নাফস্
ইসলামিক শিক্ষাগুলো মানব আত্মার এবং এর অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের বিষয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। নাফস্, যা নিজস্বতাকে বা অহংকারকে বোঝায়, আমাদের আচরণ এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ককে মুর্ত করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জিহাদ আল-নাফস্—নিজের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ—সফলভাবে চালানোর জন্য, নাফস্ এর বিভিন্ন স্তর এবং সেগুলি আমাদের কর্মগুলোতে কীভাবে প্রভাব ফেলে তা বোঝা প্রয়োজন। এই অধ্যায়ে, আমরা কুরআন এবং হাদীসে উল্লিখিত তিন ধরনের নাফস্ সম্পর্কে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবঃ ‘‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ (অহংকারী আত্মা), ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’ (ভ্রান্তি সংশোধনকারী আত্মা) এবং ‘নাফস্ আল-মুতমাইন্নাহ’ (প্রশান্ত আত্মা)।
এই প্রতিটি স্তর একটি ব্যক্তির আধ্যাত্মিক বিকাশ এবং ইচ্ছাশক্তির উপর নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পর্যায়কে উপস্থাপন করে। আমরা এই আধ্যাত্মিক স্তরের মধ্যে কোথায় আছি তা বুঝে আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে এবং আমাদের জীবনকে আল্লাহর আদেশের সাথে মিলিয়ে নিতে কাজ করতে পারি।
১। নাফস্ আল আম্মারাহঃ অহংকারী আত্মা
‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ হল নাফস্ এর সর্বনিম্ন স্তর এবং এটি সেই আত্মাকে বোঝায় যা পাপ ও অবাধ্যতার দিকে ঝুঁকে থাকে। এই ধরণের আত্মা একজন ব্যক্তিকে পাপাচারে এবং অনৈতিক আচরণে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করে। ‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ এর ইচ্ছাগুলো পার্থিব ও ভোগবাদী হয়, যা তাৎক্ষণিক তৃপ্তি এবং স্বার্থপরতার উপর ভিত্তি করে। এই পর্যায়ে থাকা ব্যক্তিরা প্রায়শই তাদের ভিত্তিগত ইচ্ছার দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে, তা ধন-সম্পদ, ক্ষমতা, খ্যাতি, বা ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তি হোক। তারা প্রায়ই বিবেচনাহীনভাবে কাজ করে, এই জীবন এবং পরকালের পরিণতি বিবেচনা না করেই।
কুরআনে এই আত্মার উল্লেখ করা হয়েছে নবী ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)-এর কাহিনিতে, যেখানে ‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ এর পাপের দিকে প্ররোচিত করার প্রবলতা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছেঃ
اِنَّ النَّفۡسَ لَاَمَّارَۃٌۢ بِالسُّوۡٓءِ اِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّیۡ
“আর আমি নিজেকে পবিত্র বলি না। নিশ্চয়ই নাফস্ পাপের দিকে প্ররোচিত করে, তবে আমার রব যার প্রতি রহম করেছেন সে ব্যতিক্রম।”
(সূরা ইউসুফ, ১২:৫৩)
এই পর্যায়ে, একজন ব্যক্তি প্রায়শই তার নিজস্ব ত্রুটি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকেন এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আত্মসচেতনতা তার মধ্যে থাকে না। তারা পাপপূর্ণ কাজগুলোকে যুক্তি দিয়ে গ্রহণযোগ্য মনে করতে পারেন অথবা আল্লাহর চোখে তাদের কাজের গুরুতরতা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞ হতে পারেন। সাধারণত, এই ধরনের ব্যক্তি নামাজ থেকে দূরে থাকেন, আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন থাকেন না এবং কুরআনের শিক্ষাগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন।
‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ এর বৈশিষ্ট্যগুলো হলোঃ
– লোভঃ অধিকতর ধন, সম্পদ বা ক্ষমতার জন্য এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা।
– কামনাঃ নিষিদ্ধ শারীরিক আনন্দের প্রতি প্রবল আকর্ষণ, যা নৈতিকতা লঙ্ঘনের দিকে পরিচালিত করে।
– রাগ এবং অহংকারঃ অল্পতেই রেগে যাওয়া, অন্যদের প্রতি অবজ্ঞা দেখানো, এবং নিজেকে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া।
– অসচেতনতাঃ আধ্যাত্মিক কল্যাণের প্রতি বা আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতার বিষয়ে সাধারণ উদাসীনতা।
যারা ‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ দ্বারা প্রভাবিত, তাদের চ্যালেঞ্জ হলো এই অসচেতনতা থেকে জাগ্রত হওয়া এবং তাদের আত্মার উপর অপ্রতিরোধযোগ্য ইচ্ছাগুলো যে ক্ষতি করছে, তা চিহ্নিত করা। এই পর্যায়টি অতিক্রম করার পথ হলো আল্লাহর দিকে আন্তরিকভাবে ফিরে আসা, নিয়মিত নামাজ পড়া, তওবা করা এবং ইচ্ছাশক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য সচেতন প্রচেষ্টা চালানো।
২। ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’: ভ্রান্তি সংশোধনকারী আত্মা
‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’ আধ্যাত্মিক সচেতনতার একটি উচ্চতর স্তরকে উপস্থাপন করে। এই আত্মা নিজের পাপের জন্য নিজেকে দোষারোপ করে এবং সংশোধন করার চেষ্টা করে। ‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ যা ভুলের ব্যাপারে অসচেতন থাকে, তার বিপরীতে ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’ তার ত্রুটি সম্পর্কে সর্বদা সচেতন এবং সেগুলো সংশোধনের চেষ্টা করে। এই স্তরটি একজন বিশ্বাসীর আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের শুরু নির্দেশ করে।
কুরআনে ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’ এর গুরুত্ব বোঝাতে আল্লাহ কসম করেছেন সূরা আল-কিয়ামাহতেঃ
وَ لَاۤ اُقۡسِمُ بِالنَّفۡسِ اللَّوَّامَۃِ ؕ﴿۲﴾
“আর আমি শপথ করছি ভ্রান্তি সংশোধনকারী আত্মার (‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’) এর।”
(সূরা আল-কিয়ামাহ, ৭৫:২)
এই পর্যায়ে, একজন ব্যক্তি তার বিবেক ও ইচ্ছার মধ্যে এক ধরনের লড়াইয়ের সম্মুখীন হন। যদিও তারা এখনও পাপের মধ্যে পড়তে পারেন, তবুও তারা দ্রুত অনুতপ্ত হন এবং তওবা করার চেষ্টা করেন। ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’ তার ত্রুটিগুলো সম্পর্কে সচেতন এবং উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু এই পথটি সবসময়ই মসৃণ নয়। ব্যক্তি আনুগত্য এবং অবাধ্যতার মধ্যে দোদুল্যমান থাকেন এবং পুরোপুরি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য তার অহংকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন।
‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’ এর বৈশিষ্ট্যগুলো হলোঃ
– আত্মসচেতনতাঃ নিজের ত্রুটিগুলো সম্পর্কে গভীর সচেতনতা, যা আত্ম-সমালোচনা এবং আত্ম-পর্যালোচনার দিকে পরিচালিত করে।
– অনুশোচনা ও তওবাঃ পাপ করার পর অনুশোচনা বোধ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনার জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা।
– অভ্যন্তরীণ সংগ্রামঃ ইচ্ছা এবং আধ্যাত্মিক কর্তব্যের মধ্যে একটি ক্রমাগত টানাপোড়েন।
– দৃঢ়সংকল্পঃ ব্যর্থতা সত্ত্বেও দুর্বলতাগুলো অতিক্রম করে আল্লাহর কাছে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য অবিরাম প্রচেষ্টা।
এই নাফস্ এর স্তরটি অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের পরিচায়ক, তবে এটি অগ্রগতিরও নির্দেশ করে। ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’ সহ ব্যক্তি আর অসচেতন নয়; তারা আত্মোন্নয়নের সংগ্রামে নিয়োজিত। ব্যক্তি বুঝতে পারে যে আধ্যাত্মিক সফলতা নাফস্ কে নিয়ন্ত্রণ করার মধ্যেই রয়েছে এবং সঠিক পথে স্থির থাকার জন্য নিয়মিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এই পর্যায়ে নিয়মিত তওবা করা, ‘তাকওয়া’ (আল্লাহর সচেতনতা) বৃদ্ধি করা এবং কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে দিকনির্দেশনা খোঁজা সফলতার জন্য অত্যাবশ্যক।
৩। নাফস্ আল-মুতমাইন্নাহঃ প্রশান্ত আত্মা
‘নাফস্ আল-মুতমাইন্নাহ’ হলো নাফস্ এর সর্বোচ্চ স্তর, যা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে প্রশান্তি ও শান্তি অর্জনকারী আত্মার প্রতিনিধিত্ব করে। এই ধরনের আত্মা সহ ব্যক্তি সফলভাবে তাদের ইচ্ছাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং তাদের আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার আদেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জীবনযাপন করছে। এই স্তরটি সকল বিশ্বাসীদের লক্ষ্য—একটি আধ্যাত্মিক সন্তুষ্টি এবং পূর্ণতার অবস্থা যেখানে পার্থিব প্রলোভনগুলো আর ব্যক্তির উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারে না।
কুরআনে এই আত্মাকে প্রশংসাসূচকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এটিকে চিরন্তন শান্তির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছেঃ
یٰۤاَیَّتُهَا النَّفۡسُ الۡمُطۡمَئِنَّۃُ ﴿٭ۖ۲۷﴾
ارۡجِعِیۡۤ اِلٰی رَبِّكِ رَاضِیَۃً مَّرۡضِیَّۃً ﴿ۚ۲۸﴾
فَادۡخُلِیۡ فِیۡ عِبٰدِیۡ ﴿ۙ۲۹﴾
وَ ادۡخُلِیۡ جَنَّتِیۡ ﴿۳۰﴾
“হে প্রশান্ত আত্মা! তোমার প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাও, তুমি তাঁকে সন্তুষ্ট করে গেছ এবং তিনিও তোমাকে সন্তুষ্ট করেছেন। আমার (মর্যাদাপূর্ণ) বান্দাদের মধ্যে প্রবেশ করো, এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো!”
(সূরা আল-ফজর, ৮৯:২৭-৩০)
এই স্তরে, ব্যক্তি চ্যালেঞ্জ থেকে মুক্ত নয়, তবে তাদের হৃদয় শান্ত থাকে, কারণ তারা জানে যে সমস্ত কিছু আল্লাহর হাতে। তারা জীবনের সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয় ধৈর্য এবং কৃতজ্ঞতা নিয়ে, আল্লাহর প্রজ্ঞার উপর পূর্ণ আস্থা রেখে। ‘নাফস্ আল-মুতমাইন্নাহ’ এর বৈশিষ্ট্যগুলো হলোঃ
– সন্তুষ্টিঃ বাইরের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, গভীর এক শান্তির অনুভূতি।
– আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাসঃ আল্লাহর পরিকল্পনার প্রতি অবিচল বিশ্বাস এবং তাঁর নির্দেশনার উপর নির্ভরশীলতা।
– নিরন্তর আল্লাহর স্মরণঃ ব্যক্তি জিকিরে (আল্লাহর স্মরণে) লিপ্ত থাকে এবং ইবাদতে আনন্দ খুঁজে পায়।
– পার্থিবতা থেকে বিচ্ছিন্নতাঃ তারা এই পৃথিবীর দায়িত্ব পালন করে, কিন্তু তারা পার্থিব অর্জন বা ক্ষতির প্রতি অতিরিক্তভাবে আসক্ত নয়।
‘নাফস্ আল-মুতমাইন্নাহ’ তাদের জন্য পুরস্কার যারা তাদের নিম্ন ইচ্ছাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার সংগ্রামে সফল হয়েছে। এই ব্যক্তিরা তাদের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেছে, যা চিরস্থায়ী অভ্যন্তরীণ শান্তি নিয়ে আসে। তারাই হলো সেই ব্যক্তি যাদের আল্লাহ তাঁর জান্নাতে প্রবেশের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তাদের ধৈর্য এবং স্থিতিশীলতার জন্য পুরস্কার হিসেবে।
নাফস্ এর তিনটি প্রকার সম্পর্কে জানা, আত্মশুদ্ধির যাত্রা শুরু করার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আপনি যদি ‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ এর প্রাথমিক আকাঙ্ক্ষাগুলোর সাথে সংগ্রাম করেন, বা ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’ এর আত্ম-সমালোচনার পর্যায় অতিক্রম করার চেষ্টা করেন, চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ‘নাফস্ আল-মুতমাইন্নাহ’ এর শান্তি এবং সন্তুষ্টি অর্জন করা। প্রতিটি স্তর নিজস্ব চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে, কিন্তু আন্তরিক প্রচেষ্টা, প্রার্থনা এবং আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতার মাধ্যমে আত্মার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে বিজয় অর্জন করা সম্ভব।
অধ্যায় ৩। কুরআনে জিহাদ আন-নাফসের গুরুত্ব
কুরআন শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক নির্দেশনার গ্রন্থ নয়, বরং এটি একজন বিশ্বাসীর অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সংগ্রামগুলো মোকাবিলা করার জন্য একটি পথনির্দেশিকা। একজন মুসলিমের অন্যতম প্রধান যুদ্ধ হলো ‘জিহাদ আন-নাফস্’—নিজের সাথে যুদ্ধ করা। এই অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে নিজের ইচ্ছাকে সংযত করা, আত্মার প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং আল্লাহর আদেশের সাথে নিজের হৃদয় এবং কাজগুলোকে সামঞ্জস্য করা। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এই ধারণাটি বারবার গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে, যাতে বিশ্বাসীদের তাদের হৃদয় পরিশুদ্ধ করতে এবং ন্যায়ের পথে চলতে উৎসাহিত করা হয়।
এই অধ্যায়ে কুরআনের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এর গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে এবং এটি কিভাবে একজন মুসলিমের সফল, আধ্যাত্মিকভাবে পূর্ণ জীবনের ভিত্তি তৈরি করে তা আলোচনা করা হয়েছে।
১। কুরআনে জিহাদের অর্থ
‘জিহাদ’ শব্দটি প্রায়ই বাহ্যিক সংগ্রামের সাথে সম্পর্কিত, যেমন নিজের বিশ্বাস বা সম্প্রদায়ের প্রতিরক্ষায় লড়াই করা। তবে, এর মূল অর্থে, ‘জিহাদ’ কেবলমাত্র “প্রচেষ্টা করা” বা “আল্লাহর পথে চেষ্টা ও পরিশ্রম করা” বোঝায়। এটি একটি বিস্তৃত শব্দ যা একজন বিশ্বাসী তাদের জীবনের শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় সংগ্রামকেই অন্তর্ভুক্ত করে।
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) উল্লেখযোগ্যভাবে বলেছেন যে, সর্বোত্তম জিহাদ হলো বাহ্যিক শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই নয় বরং নিজের আত্মা এবং প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাঃ
“সর্বোত্তম জিহাদ হলো নিজের আত্মা (নাফস্) এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে আল্লাহর আনুগত্যে যুদ্ধ করা।”
এই গভীর বক্তব্যটি নাফস্ নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বকে তুলে ধরে, যা সবচেয়ে কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ হিসেবে বিবেচিত। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এই ধারণা পুনরায় উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে বিশ্বাসীদের তাদের হীন ইচ্ছাগুলো প্রতিহত করতে এবং তাদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতাকে আলিঙ্গন করতে সহায়তা করা হয়।
২। কুরআনে জিহাদ আন-নাফস্ সম্পর্কে আয়াতসমূহ
কুরআন বহু আয়াতের মাধ্যমে বিশ্বাসীদের তাদের ইচ্ছা ও প্রলোভনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার নির্দেশনা দেয়। এই আয়াতগুলো ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এর বিভিন্ন রূপ সম্পর্কে ধরণা প্রদান করে, যার মধ্যে রয়েছে আত্মসংযম থেকে শুরু করে আন্তরিক তওবা।
– আত্মসংযম ও ধৈর্যঃ
নাফস্ এর বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রধান উপায়গুলোর একটি হলো ধৈর্য (‘সবর’)। কুরআনে বারবার বিশ্বাসীদেরকে ধৈর্যের অনুশীলন করার আহ্বান জানানো হয়েছে, তা অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক যে পরীক্ষাই হোক না কেন। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের জন্য সীমাহীন পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেনঃ
اِنَّمَا یُوَفَّی الصّٰبِرُوۡنَ اَجۡرَهُمۡ بِغَیۡرِ حِسَابٍ ﴿۱۰﴾
“নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের তাদের পুরস্কার নির্দিষ্ট হিসাব ছাড়াই দেওয়া হবে।”
(সুরাহ আজ-জুমার, ৩৯:১০)
‘জিহাদ আন-নাফস্’ এর প্রেক্ষিতে ধৈর্য অর্থ হলো নিষিদ্ধ ইচ্ছাগুলো পূরণ করার প্রলোভন থেকে বিরত থাকা, পাপ থেকে দূরে থাকার কষ্ট সহ্য করা, এবং নিজেকে ক্রমাগত উন্নত করার প্রচেষ্টা করা।
– পাপকর্ম থেকে দূরে থাকাঃ
কুরআন নাফস্ এর প্রলোভনকে অনুসরণ করা এবং পাপাচারের মধ্যে জড়িয়ে পড়া সম্পর্কে সতর্ক করে। এটি বিশ্বাসীদেরকে শয়তান (‘শাইতান’) এর কুমন্ত্রণায় এবং নিজের স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষার থেকে তাদের হৃদয় ও কাজকে রক্ষা করার জন্য আহ্বান জানায়ঃ
وَ لَا تَتَّبِعِ الۡهَوٰی فَیُضِلَّكَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ
“এবং তোমার ইচ্ছার অনুসরণ করো না, কারণ তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে।”
(সুরাহ সাদ, ৩৮:২৬)
এই আয়াতটি দেখায় কিভাবে নাফসের ইচ্ছার অনুসরণ মানুষকে সঠিক পথ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ বিশ্বাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা তাদের নাফস্ কে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ক্ষণস্থায়ী সুখের চেয়ে আল্লাহর আদেশকে অগ্রাধিকার দেয়।
– তাজকিয়ার পুরস্কার (আত্মশুদ্ধি):
কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এই জীবন এবং পরকালে সফলতার চাবিকাঠি হলো আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা। ‘তাজকিয়া’—আত্মার শুদ্ধি—হলো ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এর কেন্দ্রবিন্দু। এর মধ্যে রয়েছে হৃদয় থেকে লোভ, হিংসা এবং অহংকারের মতো মন্দ গুণগুলোকে দূর করা এবং এগুলোর পরিবর্তে নম্রতা, উদারতা, এবং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার মতো গুণাবলি ধারণ করা।
قَدۡ اَفۡلَحَ مَنۡ زَكّٰىهَا ۪ۙ﴿۹﴾
وَ قَدۡ خَابَ مَنۡ دَسّٰىهَا ﴿ؕ۱۰﴾
“সফল হয়েছে সে, যে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে; এবং ব্যর্থ হয়েছে সে, যে আত্মাকে কলুষিত করেছে।”
(সুরাহ আশ-শামস, ৯১:৯-১০)
এই আয়াতটি মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃত সফলতা সামগ্রিক ধনসম্পদ বা জাগতিক অর্জনের মাধ্যমে পরিমাপ করা হয় না, বরং একজনের আত্মার অবস্থা দ্বারা নির্ধারিত হয়। নাফস্ কে অবিরত পরিশুদ্ধ করতে হবে, এবং যারা এই অভ্যন্তরীণ সংগ্রামে অংশ নেয়, তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে সফলতা অর্জন করে।
৩। জিহাদ আন-নফসে সালাত, রোজা ও যাকাতের ভূমিকা
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ—ঈমান, সালাত, রোজা, যাকাত এবং হজ—শুধুমাত্র ইবাদতের মাধ্যম নয়, বরং নাফস্ এর বিরুদ্ধে লড়াই করার গুরুত্বপূর্ণ উপায়। এই স্তম্ভগুলো একজন বিশ্বাসীকে তার ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণের অভ্যন্তরীণ সংগ্রামে সহায়তা করে এবং তার সংকল্পকে দৃঢ় করে তোলে।
(চলবে-)
মন্তব্য করুন