নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধঃ কুরআন ও হাদীসের আলোকে আত্মসংগ্রাম

তৃতীয় পর্ব-নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধঃ কুরআন ও হাদীসের আলোকে আত্মসংগ্রাম

তৃতীয় পর্ব

– সালাত (নামাজ):

সালাত হলো আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সবচেয়ে ঘন ঘন এবং সরাসরি মাধ্যম। এটি একজনের উদ্দেশ্যকে নিয়মিত মনে করিয়ে দেয় এবং নাফস্ নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাসীর সংকল্পকে শক্তিশালী করে। আন্তরিকভাবে আদায়কৃত নামাজ আত্মাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে, অহংকে প্রশমিত করে এবং নিজেদের দুর্বলতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার একটি নিয়মিত সুযোগ প্রদান করে।

কুরআন নামাজের পরিবর্তনশীল শক্তির কথা উল্লেখ করেছে, যা পাপ থেকে বিরত রাখেঃ

اِنَّ الصَّلٰوۃَ تَنۡهٰی عَنِ الۡفَحۡشَآءِ وَ الۡمُنۡكَرِ ؕ

“নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে।”

(সুরাহ আল-আনকাবুত, ২৯:৪৫)

নিয়মিত, আন্তরিকভাবে নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি প্রলোভন প্রতিরোধে এবং আত্মাকে শুদ্ধ করার দিকে মনোযোগ দিতে পারেন।

– রোজা (সাওম):

বিশেষ করে রমজান মাসে রোজা রাখা হলো ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এর সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর একটি। খাবার, পানীয় এবং অন্যান্য শারীরিক ইচ্ছা থেকে বিরত থেকে একজন বিশ্বাসী তার আত্মাকে সংযত রাখতে শিখে। রোজা আত্ম-সংযম ও ধৈর্য শেখায়, যা নাফস্ নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গুণ।

নবী মুহাম্মদ (সা.) রোজাকে পাপের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে উল্লেখ করেছেনঃ

“রোজা হলো ঢাল, যা দ্বারা একজন বান্দা নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করে।”

(সহীহ মুসলিম)

রোজা শুধু শারীরিক খাদ্য থেকে বিরত থাকা নয়, এটি নিজের প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ অনুশীলন, চরিত্রের শুদ্ধি এবং আল্লাহর নৈকট্য অনুসন্ধানের মাধ্যম।

– যাকাত (দান):

দান করা হলো আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার এবং নাফস্ এর স্বার্থপর প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার আরেকটি উপায়। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সম্পদ দান করার মাধ্যমে একজন বিশ্বাসী বস্তুবাদের প্রতি আসক্তি কমিয়ে লোভকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। যাকাত উদারতা, সহানুভূতি এবং অন্যদের কল্যাণের প্রতি দায়িত্ববোধ তৈরি করে।

কুরআন সরাসরি দানের কাজের সাথে আত্মার পরিশুদ্ধি যুক্ত করেছেঃ

خُذۡ مِنۡ اَمۡوَالِهِمۡ صَدَقَۃً تُطَهِّرُهُمۡ وَ تُزَكِّیۡهِمۡ بِهَا وَ صَلِّ عَلَیۡهِمۡ

“তাদের ধন-সম্পদ থেকে দান গ্রহণ কর, যার দ্বারা তুমি তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবে এবং তাদের কল্যাণ বৃদ্ধি করবে।”

(সুরাহ আত-তওবাহ, ৯:১০৩)

নিয়মিতভাবে দান করার মাধ্যমে একজন মানুষ তার হৃদয়ে নাফস্ এর প্রভাব কমিয়ে আনে এবং আল্লাহর আদেশের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে নিজেকে সংযুক্ত করে।

৪। জিহাদ আন-নফসে নিয়োজিত হওয়ার জন্য ব্যবহারিক পদক্ষেপসমূহ

কুরআন স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে কীভাবে নাফস্ এর বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ লড়াইকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করা যায়। কিছু ব্যবহারিক পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছেঃ

– আল্লাহর স্মরণে নিয়মিত লিপ্ত থাকা (যিকর):

হৃদয়কে আল্লাহর স্মরণে নিয়োজিত রাখা পাপের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটি ঢালের মতো কাজ করে। কুরআন বিশ্বাসীদের সব পরিস্থিতিতে আল্লাহর স্মরণে থাকা নির্দেশ দিয়েছেঃ

یٰۤاَیُّهَاالَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اذۡكُرُوا اللّٰهَ ذِكۡرًا كَثِیۡرًا﴿ۙ۴۱﴾

“হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো।”

(সুরাহ আল-আহজাব, ৩৩:৪১)

যিকর হৃদয় ও মনকে শক্তিশালী করে, যা নাফস্ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং আধ্যাত্মিক লক্ষ্যগুলোর দিকে মনোযোগ রাখতে সহায়তা করে।

– জ্ঞান অন্বেষণ ও চিন্তাভাবনা করাঃ

কুরআন বিশ্বাসীদেরকে জ্ঞান অন্বেষণ করতে এবং বিশ্বজগত ও নিজেদের মধ্যে আল্লাহর নিদর্শনগুলোর উপর চিন্তা করতে উৎসাহিত করে। নাফস্ অনুসরণ করার পরিণতি এবং এটিকে পরিশুদ্ধ করার পুরস্কার সম্পর্কে বোঝা আমাদের আত্ম-সচেতনতা ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ায়।

– নিয়মিত তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করাঃ

কেউই নাফস্ এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়, তবে কুরআন আল্লাহর ক্ষমা চাইতে এবং পাপের পরে তাঁর দিকে ফিরে যাওয়ার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেঃ

اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ التَّوَّابِیۡنَ وَ یُحِبُّ الۡمُتَطَهِّرِیۡنَ ﴿۲۲۲﴾

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা বার বার তাওবা করে।”

(সুরাহ আল-বাকারা, ২:২২২)

তাওবা হলো আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ, যা বিশ্বাসীকে তার ভুল থেকে শিখতে এবং ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এ অবিচলভাবে অগ্রসর হতে সহায়তা করে।

কুরআন নাফস্ এর বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ সংগ্রামে সম্পূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করেছে এবং ‘জিহাদ আন-নাফস্’ কে একজন বিশ্বাসীর আধ্যাত্মিক যাত্রার মূল ভিত্তি হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছে। নামাজ, রোজা, দান এবং আল্লাহর নিয়মিত স্মরণের মাধ্যমে একজন ধীরে ধীরে তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে, ইচ্ছাগুলোকে সংযত করতে এবং তার প্রভুর নৈকট্য লাভ করতে পারে। পরবর্তী অধ্যায়ে, আমরা হাদিসের ভূমিকা এবং নবী মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনের ব্যবহারিক উদাহরণের মাধ্যমে ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এর নীতিগুলো কীভাবে আরও স্পষ্ট হয়, তা অনুসন্ধান করব ইনশাআল্লাহ্।

চতুর্থ অধ্যায়ঃ জিহাদ আন-নফসে হাদিসের ভূমিকা

যেখানে কুরআন ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এর ধারণার ভিত্তি স্থাপন করেছে, সেখানে হাদিস—নবী মুহাম্মদ (সা.) এর বাণী, কাজ এবং অনুমোদনসমূহ—এই অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের বিষয়ে আরও স্পষ্ট ব্যাখ্যা, ব্যবহারিক উদাহরণ এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করেছে। নবী (সা.) মুসলমানদের জন্য আদর্শ রোল মডেল হিসেবে নাফস্ এর আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে লড়াই করতে হয় এবং ধৈর্য, বিনয় এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের মতো গুণাবলী কীভাবে গড়ে তুলতে হয় তা প্রদর্শন করেছেন।

এই অধ্যায়ে আমরা হাদিস কীভাবে মুসলমানদের ‘জিহাদ আন-নাফস্’ বুঝতে এবং চর্চা করতে সাহায্য করে তা অন্বেষণ করার প্রয়াস পাব, বিশেষ করে নবী (সা.) এর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বাণী ও উদাহরণগুলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করব।

১। বৃহত্তর জিহাদ সম্পর্কে হাদিস

‘জিহাদ আন-নাফস্’ সম্পর্কিত সবচেয়ে সুপরিচিত হাদিসগুলোর মধ্যে একটি হলো “বৃহত্তর জিহাদ” এবং “ক্ষুদ্র জিহাদ” এর মধ্যে পার্থক্য। এক সামরিক অভিযানের পর ফিরে আসার সময় নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছিলেনঃ

“আমরা ক্ষুদ্র জিহাদ (বাহ্যিক যুদ্ধ) থেকে বৃহত্তর জিহাদ বা জিহাদ ই আকবর (নিজের নাফসের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ) এ ফিরে এসেছি।”

(আল-বাইহাকী, আল-জুহদ আল-কবির)

এই বক্তব্যটি ‘জিহাদ আন-নাফস্’ কে শারীরিক যুদ্ধের তুলনায় আরও গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম হিসেবে তুলে ধরে। এটি মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যদিও তাদের বিশ্বাস ও সম্প্রদায়কে রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, নিজের নাফস্ ও আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে যুদ্ধ হলো আজীবন চলমান একটি চ্যালেঞ্জ, যা অবিরাম প্রচেষ্টা এবং শৃঙ্খলা প্রয়োজন।

নবী (সা.) এর ‘জিহাদ আন-নাফস্’ কে “বৃহত্তর জিহাদ” হিসেবে শ্রেণীভূক্ত করা মুসলিম জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে এই আধ্যাত্মিক যুদ্ধকে স্থান দিয়েছে। এটি মনে করিয়ে দেয় যে, এই পৃথিবী এবং পরকালীন জীবনে প্রকৃত সাফল্য নির্ভর করে একজন ব্যক্তির নিজের নাফস্ কে নিয়ন্ত্রণ করার, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য বজায় রাখার এবং তার ইচ্ছাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতার উপর।

২। নাফস্ কে মোকাবেলা করার জন্য হাদিস থেকে ব্যবহারিক নির্দেশনা

হাদিস শাস্ত্রে ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এ অংশগ্রহণের জন্য বিভিন্ন ব্যবহারিক টিপস প্রদান করে। নবী মুহাম্মদ (সা.) রাগ নিয়ন্ত্রণ, আকাঙ্ক্ষা পরিচালনা, এবং বিনয় ও ধৈর্য অনুশীলনের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন, যা নাফস্ কে দমন করার জন্য অপরিহার্য। নীচে নাফস্ কে মোকাবেলা করার কিছু মূল শিক্ষার উল্লেখ করা হলো।

– রাগ নিয়ন্ত্রণ করাঃ 

রাগ হল একটি ধ্বংসাত্মক আবেগ যা নাফস্ এর আকাঙ্ক্ষাকে উসকে দিতে পারে। নবী (সা.) রাগ নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন, কারণ এটি প্রায়শই তাড়াহুড়ো করে কাজ, অহংকার এবং পাপাচারে নিয়ে যায়।

নবী (সা.) বলেছেনঃ

“শক্তিশালী মানুষ সেই নয় যে কুস্তিতে ভালো, বরং শক্তিশালী মানুষ হল সেই যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।”

(সহীহ আল-বুখারি)

এই হাদিসটি আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে সত্যিকারের শক্তি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্যে নিহিত, বিশেষ করে যখন রাগের মতো আবেগ প্রাধান্য পায়। রাগ নিয়ন্ত্রণ করা ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এর একটি মূল দিক এবং এটি ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কগুলিতে ভারসাম্য ও শান্তি বজায় রাখতে অপরিহার্য।

– লালসার বিরুদ্ধে প্রতিরোধঃ

নাফস্ প্রায়শই তাত্ক্ষণিক তৃপ্তির জন্য আকাঙ্ক্ষিত হয়, সেটা অর্থ, খাবার, বা অন্যান্য শারীরিক আনন্দের মাধ্যমে হোক। নবী (সা.) এসব লালসার দিকে ধাবিত হওয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন, কারণ তা দীর্ঘমেয়াদী আধ্যাত্মিক পরিণতিকে উপেক্ষা করে।

তিনি বলেছেনঃ

“যে কেউ আল্লাহর জন্য কিছু ত্যাগ করে, আল্লাহ তার পরিবর্তে কিছু ভালো দান করবেন।”

(মুসনাদ আহমদ)

এই হাদিসটি মুসলমানদেরকে তাত্ক্ষণিক তৃপ্তির আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার জন্য উৎসাহিত করে, যাতে তারা পরকালীন পুরস্কারের দিকে মনোনিবেশ করে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাত্ক্ষণিক তৃপ্তি ত্যাগ করা ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এর একটি মৌলিক দিক, এবং এই হাদিস মুসলমানদেরকে আশ্বস্ত করে যে তাদের প্রচেষ্টা বৃথা যাবে না।

ঢাল হিসাবে রোজাঃ

নাফস্ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপকরণের মধ্যে একটি হল রোজা। রোজা পালন ধৈর্য, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলা শেখায়। নবী (সা.) রোজার গুরুত্বকে শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবেই নয়, বরং নাফস্ নিয়ন্ত্রণের একটি উপায় হিসেবেও তুলে ধরেছেন।

তিনি বলেছেনঃ

“রোজা হল একটি ঢাল; এটি আপনাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে এবং পাপাচার থেকে বিরত রাখবে।”

(সহীহ আল-বুখারি)

রোজা একজন ব্যক্তিকে খাবার, পানীয় এবং অন্যান্য শারীরিক আকাঙ্ক্ষার চক্র ভঙ্গ করতে সাহায্য করে, যা আধ্যাত্মিক বিকাশের উপর মনোনিবেশ করা সহজ করে। শরীরের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা সাময়িকভাবে অস্বীকার করে, মুসলমান তার সংকল্পকে শক্তিশালী করে এবং নাফস্ এর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

– বিনয় গ্রহণ এবং অহংকার বর্জনঃ

অহংকার (‘কিবর’) হল নাফস্ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি প্রধান বাধা। নাফস্ প্রায়শই স্বীকৃতি, প্রশংসা এবং মর্যাদা চায়, যা গর্ব এবং অন্যদের উপর প্রাধান্য অনুভব করার দিকে নিয়ে যেতে পারে। নবী (সা.) এই বিষয়টির বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন, কারণ অহংকার আল্লাহর জন্য সবচেয়ে ঘৃণিত গুণাবলীর মধ্যে একটি।

তিনি বলেছেনঃ

“যার হৃদয়ে একটি পরমাণুর ওজনের অহংকার রয়েছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।”

(সহীহ মুসলিম)

বিনয় ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এর একটি মূল গুণ, কারণ এটি একজন ব্যক্তিকে তার সীমাবদ্ধতাগুলি চিনতে, আল্লাহর করুণার উপর নির্ভর করতে এবং অন্যদের সাথে সদয় ও সম্মানের সাথে আচরণ করতে সক্ষম করে। নবীর বিনয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া মুসলমানদেরকে অহংকারের দ্বারা চালিত নাফস্ এর আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য উত্সাহিত করে, যা ক্ষমতা ও স্বীকৃতি চায়।

৩। নবীর ব্যক্তিগত উদাহরণ ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এ 

নবী মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন ‘জিহাদ আন-নাফস্’ সফলভাবে পরিচালনার চূড়ান্ত উদাহরণ। তিনি তাঁর জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তাঁর আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রদর্শন করেছেন, সবসময় আল্লাহর প্রতি আস্থা রেখে পার্থিব আনন্দ এ প্রলোভিত হননি। তাঁর বিনয়, ধৈর্য, এবং আল্লাহর প্রতি অবিচল নিবেদন সকল মুসলমানের জন্য একটি আদর্শ হিসেবে কাজ করে, যারা নিজেদের আত্মাকে পবিত্র করতে চেষ্টা করছে।

– সরলতা এবং সন্তোষঃ

আল্লাহর শেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হিসেবে তাঁর মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও নবী (সা.) অত্যন্ত সরল জীবনযাপন করেছেন। তিনি অতি সাধারণ পোশাক পরিধান করেছেন এবং সীমিত খাবার খেয়েছেন, যদিও তাঁর কাছে সম্পদ এবং বিলাসিতা ছিল। তাঁর অল্পে সন্তুষ্টি একটি শক্তিশালী স্মারক যে নাফস্ কে আধ্যাত্মিক ধনকে ভোগ্য ধনের উপর মূল্যায়ন করতে প্রশিক্ষিত করতে হবে।

যখন তাঁর স্ত্রী আয়েশা (রা.) তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেন তিনি এতো সরল জীবন বেছে নিয়েছেন, তিনি বলেছিলেনঃ

“আমার দুনিয়ার সাথে কি সম্পর্ক? আমি একজন পথিকের মতো, যে একটি গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করে এবং তারপর চলে যায়।”

(সুনান আল-তিরমিজি)

এই হাদিসটি নবীর পৃথিবীসংক্রান্ত আকাঙ্ক্ষার থেকে বিচ্ছিন্নতার উদাহরণ দেয়। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) দেখান যে এই দুনিয়া অস্থায়ী, এবং প্রকৃত সন্তোষ চিরন্তন পরকালে পৌঁছানোর চেষ্টা করায়।

– কষ্ট ও আনন্দের সময় ধৈর্যঃ

নবুয়তের সময়কাল জুড়ে, প্রিয় রাসুল মুহাম্মদ (সা.) অসীম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন—নিপীড়ন, ক্ষতি, ক্ষুধা, এবং বিশ্বাসঘাতকতা। তবে প্রতিটি পরিস্থিতিতে, তিনি অসাধারণ ধৈর্য এবং আল্লাহর উপর ভরসা প্রদর্শন করেছেন। পরীক্ষার সময় শান্ত, স্থির এবং দৃঢ় থাকা তাঁর ক্ষমতা নাফস্ এর উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণের প্রমাণ।

তিনি বলেছেনঃ

“সত্যিকার ধৈর্য হচ্ছে কষ্টের প্রথম ধাক্কায়।”

(সহীহ আল-বুখারি)

নাফস্ এর আবেগজনিত প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, নবী (সা.) এমনকি সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাগুলির সাথেও মর্যাদা এবং অনুগ্রহ এর সাথে মোকাবেলা করতে সক্ষম হন। তাঁর উদাহরণ দেখায় যে ধৈর্য ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এর একটি অপরিহার্য অংশ, যা ঈমানদারদেরকে আল্লাহর জ্ঞান ও সময়ের উপর বিশ্বাস করতে সক্ষম করে।

– উদারতাকে আঁকড়ে থাকা এবং স্বার্থপরতা ত্যাগঃ 

নবী (সা.) তাঁর অতুলনীয় উদারতার জন্য পরিচিত ছিলেন, প্রায়শই তিনি যা কিছু পেতেন তা দরিদ্রদেরকে দান করতেন। এই স্বার্থপরতা ত্যাগ নাফস্ এর উপর সম্পূর্ণ বিজয় প্রতিফলিত করে, যা সাধারণত পার্থীব সম্পদ মোহ মুক্ততার প্রতি এবং ব্যক্তিগত সান্ত্বনার প্রতি প্রবণ।

নবী (সা.) একবার বলেছেনঃ

“সর্বোত্তম মানুষ তারা, যারা অন্যদের জন্য সবচেয়ে উপকারী।”

(আল-মুজাম আল-আওসাত)

অন্যদের জন্য উৎসর্গ করার তাঁর ইচ্ছা, কোন পুরস্কারের প্রত্যাশা ছাড়াই, একটি উচ্চ স্তরের আধ্যাত্মিক পরিশোধনের প্রমাণ। যারা ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এ চেষ্টা করছেন, নবীর উদাহরণ তাদেরকে উদারতা, সহানুভূতি, এবং অন্যদের সেবা করার মনোভাব গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে।

৪। ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এ ইস্তিগফার (ক্ষমা চাওয়া) এর ভূমিকা 

নাফস্ নিয়ন্ত্রণের সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে পাপ এবং ভুলের প্রতি প্রবণ। নবী (সা.) এটি স্বীকার করেছেন এবং একটি সহজ, কিন্তু শক্তিশালী সমাধান প্রদান করেছেনঃ ‘ইস্তিগফার’, অর্থাৎ আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। একটি ব্যক্তি যতই নাফস্ এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে পিছিয়ে পড়ুক, সৎভাবে অনুতপ্ত হলে আল্লাহর দয়ার দরজা খুলে যায় এবং বিশ্বাসী নতুনভাবে শুরু করার সুযোগ পায়।

নবী (সা.) বলেছেনঃ

“আল্লাহর কসম, আমি প্রতিদিনের অধিকতর সত্তর বার আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তাঁর কাছে তওবা করি।”

(সহীহ আল-বুখারি)

এই হাদিসটি আত্মাকে পবিত্র করার প্রক্রিয়ায় নিয়মিত তওবার গুরুত্ব তুলে ধরে। এমনকি নবী, যিনি মাসুম বা পাপমুক্ত ছিলেন, তিনি বার বার ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন, যা সকল বিশ্বাসীর জন্য একটি উদাহরণ স্থাপন করে। ‘ইস্তিগফার’ নাফস্ কে বিনয়ী করে, ব্যক্তিকে আল্লাহর দয়ার উপর নির্ভরশীলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, এবং আধ্যাত্মিক পরিষ্কারের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।

হাদিসগুলি ‘জিহাদ আন-নাফস্’ এ যুক্ত হওয়ার উপর মূল্যবান নির্দেশনা প্রদান করে, নবী মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন থেকে তাত্ত্বিক শিক্ষা এবং কার্যকর উদাহরণ উভয়ই উপস্থাপন করে। নবীর (সা.) কথাবার্তা এবং কার্যকলাপের মাধ্যমে, তিনি আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণের, বিনয় অনুশীলন করার, এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তাঁর উদাহরণ সকল বিশ্বাসীর জন্য একটি চিরকালীন নির্দেশনা হিসেবে রয়ে গেছে, যারা নিজেদের আত্মাকে পবিত্র করতে এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে চান।

পরবর্তী অধ্যায়ে, আমরা নাফস্ এর স্তরগুলি এবং কিভাবে প্রতিটি স্তর আত্ম-পবিত্রকরণের যাত্রায় আধ্যাত্মিক উন্নতির ভিন্ন স্তরকে প্রতিফলিত করে তা নিয়ে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ্।

অধ্যায় ৫। ইসলামী চিন্তায় নাফস্ এর স্তরগুলি

ইতিহাসজুড়ে ইসলামী পণ্ডিত ও সুফিরা নাফস্ কে গভীরভাবে গবেষণা করেছেন, যা একটি মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নয়নকে প্রতিফলিত করে এমন বিভিন্ন স্তর বা স্তরগুলো চিহ্নিত করেছে। নাফস্, মানব প্রকৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে, ক্রমাগত পরিশুদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একজন যখন আধ্যাত্মিক বিকাশে অগ্রসর হন, তখন নাফস্ একটি ভিত্তিহীন, অহং-চালিত অবস্থান থেকে আল্লাহর ইচ্ছার সাথে মিলে যাওয়া অবস্থায় উন্নীত হয়। এই স্তরগুলো বুঝতে পারলে বিশ্বাসীদের আত্ম-পবিত্রকরণ ও আধ্যাত্মিক সন্তোষের পথে গাইড করা সহজ হয়।

এই অধ্যায়ে, আমরা ইসলামী চিন্তায় বর্ণিত নাফস্ এর তিনটি প্রধান স্তর নিয়ে আলোচনা করবোঃ ‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ (আদেশকারী আত্মা), ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’ (স্ব-অভিযোগকারী আত্মা), এবং ‘নাফস্ আল মুতমাইন্নাহ্’ (প্রশান্ত আত্মা)।

১। নাফস্ আল-আম্মারাহ্ (আদেশকারী আত্মা)

নাফস্ এর প্রথম এবং সর্বনিম্ন স্তরটিকে ‘‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’’ বলা হয়, অর্থাৎ আদেশকারী আত্মা। এটি মানুষের আত্মার মৌলিক, পশুর মতো অংশ, যা আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা এবং পার্থিব আনন্দের অনুসরণ দ্বারা চালিত হয়। এটি আত্মার সেই অংশ যা একজন ব্যক্তিকে নৈতিক বা আধ্যাত্মিক পরিণতি নিয়ে চিন্তা না করে তাদের প্রবৃত্তি এবং ইচ্ছার ভিত্তিতে কাজ করতে নির্দেশ করে।

কুরআনে আল্লাহ এই নাফস্ এর স্তর বর্ণনা করেছেনঃ

اِنَّ النَّفۡسَ لَاَمَّارَۃٌۢ بِالسُّوۡٓءِ اِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّیۡ

“নিশ্চয়ই, আত্মা সবসময় মন্দের প্রতি প্রবণ, তারা ব্যতিত যারা আমার প্রভুর রহমত পায়।”

(সূরা ইউসুফ, ১২:৫৩)

এই স্তরে, নাফস্ লোভ, ক্রোধ, কামনা এবং অহংকারের মতো প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত হয়। এটি তাৎক্ষণিক তৃপ্তি খোঁজে এবং এর কাজের নৈতিক পরিণতি নিয়ে চিন্তা করে না। যে ব্যক্তি এই অবস্থায় আছে, তিনি প্রায়ই তাদের আকাঙ্ক্ষার দ্বারা দাস হয়ে যান, যা তাদের পাপ করার এবং আল্লাহর পথে বিচ্যুত করার দিকে পরিচালিত করে।

– নাফস্ আল-আম্মারাহ্’র বৈশিষ্ট্যঃ 

– আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অভাব

– পার্থিব আকাঙ্ক্ষা এবং ভৌত ধনসম্পত্তির অনুসরণ

– পাপমূলক আচরণের বৈধতা

– আধ্যাত্মিক দায়িত্বের প্রতি উদাসীনতা

‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ কে অতিক্রম করতে নিয়মিত সতর্কতা, আত্মশৃঙ্খলা এবং নিয়মিত নামাজ, রোজা, এবং আত্ম-সমালোচনার বা ধ্যান সাধনার মতো ভালো অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই স্তর অতিক্রম করার প্রক্রিয়া জিহাদ আল-নাফস্ এর সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু।

(চলবে-)

মোঃ শফিকুল ইসলাম প্রিয়

এই প্রকাশনাটির সর্বস্বত্ত লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত। এই প্রকাশনার আংশিক বা সম্পুণাংশ অন্য যেকোন মিডিয়াতে লেখকের নামে ছাড়া অন্য কারও নামে প্রকাশ করা কপিরাইট আইন এ দন্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গন্য হবে।...

১ টি মন্তব্য

error: কন্টেন্ট কপি এবং পেস্ট protected!!