shofiq.com
​শুভঙ্করের ফাঁকি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতি ও পশ্চিমা ব্যর্থতা ঢাকার কৌশল

​শুভঙ্করের ফাঁকি: ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতি ও পশ্চিমা ব্যর্থতা ঢাকার কৌশল

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার বর্তমান উদ্যোগকে নিছক শুভঙ্করের ফাঁকি বা পশ্চিমা বিশ্বের ব্যর্থতা ঢাকার একটি কৌশল হিসেবে বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জরুরি। এই আলোচনাকে গভীর ও দীর্ঘ পরিসরে উপলব্ধি করতে হলে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ঐতিহাসিক দায়িত্ব এবং সার্বভৌমত্বের মৌলিক ধারণাকে বিচার করতে হবে।

ভূমিকা: স্বীকৃতির আড়ালে ব্যর্থতার আখ্যান

বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তা আপাতদৃষ্টিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার একটি শুভ পদক্ষেপ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কঠোর রিয়্যালপোলিটিকের (Realpolitik) দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই পদক্ষেপকে decades of নিষ্ক্রিয়তা, দ্বিমুখী নীতি এবং আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগে পশ্চিমা বিশ্বের ভয়াবহ ব্যর্থতা ঢাকার একটি মরিয়া চেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি যদি সত্যিকারের সার্বভৌমত্ব ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না করে, তবে এটি কেবল একটি প্রতীকী ও দুর্বল কূটনৈতিক পদক্ষেপ, যা বৃহৎ সংঘাতের মূল কারণগুলিকে জিইয়ে রাখবে।

পশ্চিমা নীতির ঐতিহাসিক ব্যর্থতা এবং দ্বিমুখী মানদণ্ড

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের মূলে রয়েছে দশকের পর দশক ধরে পশ্চিমা বিশ্বের অনুসৃত দ্বিমুখী মানদণ্ড (Double Standards) আমরা বারবার দেখেছি:

১. জাতিসংঘের রেজোলিউশনে ব্যর্থতা: জাতিসংঘের অসংখ্য নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদের রেজোলিউশন, যা ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকে অবৈধ ঘোষণা করেছে এবং ১৯৬৭ সালের সীমান্ত অনুযায়ী দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে রায় দিয়েছে, তা কার্যকর করতে পশ্চিমা শক্তিগুলো বারবার ব্যর্থ হয়েছে। তারা ইসরায়েলকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে গেছে, যা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বদলে তাদের উৎসাহিত করেছে।

২. ইউক্রেন বনাম ফিলিস্তিন: পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখালেও, ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে তারা দশকের পর দশক ধরে দখলদারিত্বের প্রশ্নে নীরব থেকেছে অথবা মৃদু প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই selective moral outrage আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পশ্চিমা বিশ্বের নৈতিক ভিত্তি সম্পূর্ণরূপে ক্ষয় করেছে।

৩. জনমতের চাপ: গাজা উপত্যকায় সাম্প্রতিক সামরিক অভিযানের ফলে বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর অভ্যন্তরেও, তীব্র জনমত সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো সেই তীব্র জনরোষ এবং নৈতিক ব্যর্থতার অভিযোগ থেকে নজর ঘোরানোর একটি দ্রুত কূটনৈতিক কৌশল। এটি কেবল মুখরক্ষার চেষ্টা, প্রকৃত নীতির পরিবর্তন নয়।

‘সার্বভৌমত্বহীন’ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি: শুভঙ্করের ফাঁকি

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি মৌলিক ধারণা হলো সার্বভৌমত্ব (Sovereignty)একটি রাষ্ট্রকে সত্যিকারের রাষ্ট্র হতে হলে তার নিজস্ব ভূখণ্ড, সীমান্ত, আকাশসীমা, প্রাকৃতিক সম্পদ, এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনকে যে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, তার স্বরূপ কী?

১. খণ্ডিত ভূখণ্ড ও সীমিত ক্ষমতা: স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কি গাজা ও পশ্চিম তীরের মধ্যে যোগাযোগ বা সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হবে? ইসরায়েলি বসতিগুলোর কী হবে? যদি স্বীকৃত রাষ্ট্রটি ইসরায়েলের সামরিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকে, তবে তার সার্বভৌমত্ব কেবল কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

২. নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ: যদি ফিলিস্তিনকে তার নিজের সীমান্তে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না দেওয়া হয় (যেমন, সামরিক উপস্থিতি ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ), তবে সেটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বদলে একটি প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ মাত্র। এটি হবে একটি “ডিকলোনাইজড” (decolonized) অঞ্চল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি একটি “স্যাটেলাইট স্টেট” (satellite state) বা বাফার জোন হিসেবে কাজ করবে।

৩. জল ও অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ: পানি ও অর্থনীতির মতো মৌলিক সম্পদগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোনো রাষ্ট্রই টিকে থাকতে পারে না। স্বীকৃতি দেওয়ার পরও যদি এই জরুরি বিষয়গুলোতে ইসরায়েলের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব বজায় থাকে, তবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি কেবল ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি দুর্বল প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হবে, যা সংঘাতের মূল কারণকে (দখলদারিত্ব) দূর করবে না।

ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য: শান্তি নয়, স্থিতিশীলতা

পশ্চিমা শক্তিগুলোর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হলো শান্তি প্রতিষ্ঠা করা নয়, বরং অস্থিরতা প্রশমিত করে তাদের নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা।

১. আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা:

মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার এবং বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব এই অঞ্চলের উত্তেজনা কমিয়ে আঞ্চলিক মিত্রদের (যেমন: সৌদি আরব ও অন্যান্য উপসাগরীয় রাষ্ট্র) সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথ মসৃণ করতে চায়। এই স্থিতিশীলতা তাদের বৃহত্তর বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা (যেমন: চীন ও রাশিয়ার প্রভাব মোকাবিলা) মোকাবিলায় মনোযোগ দিতে সাহায্য করবে।

২. বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার:

বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথ (Global South) বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে, পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি তীব্র অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রবক্তা হিসেবে তাদের ভাবমূর্তি ধূলিসাৎ হয়েছে। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া সেই ক্ষয়িষ্ণু নৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধারের একটি প্রচেষ্টা। এটি মূলত একটি জনসংযোগ কৌশল (Public Relations Stunt)

উপসংহার: প্রতীকের চেয়ে প্রয়োজন জবাবদিহিতা

আমার চূড়ান্ত বিশ্লেষণ হলো:

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার বর্তমান উদ্যোগ মূলত পশ্চিমা বিশ্বের দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও নৈতিক দ্বিখণ্ডনকে ঢাকার একটি প্রসাধনমূলক কৌশল। এই স্বীকৃতি যতক্ষণ না পর্যন্ত নিম্নলিখিত বিষয়গুলি নিশ্চিত করতে পারছে:

 * ১৯৬৭ সালের সীমান্ত অনুযায়ী ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে পূর্ণ ইসরায়েলি প্রত্যাহার।

 * ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন বন্ধ এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

 * জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে একটি যৌথ ও গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানো।

 * একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ ও কার্যকর সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা।

ততক্ষণ পর্যন্ত এই স্বীকৃতি কেবল একটি প্রতীকী বিজয় হিসেবেই থাকবে, যা সংঘাতের মূল কারণ, অর্থাৎ দখলদারিত্ব এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অসম্মানকে আড়াল করে রাখবে। ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য সত্যিকারের ন্যায়বিচার এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে, কথার চেয়ে কাজের গুরুত্ব বেশি, আর সেই কাজের সূচনা হওয়া উচিত জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং আন্তর্জাতিক আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে।

মোঃ শফিকুল ইসলাম প্রিয়

এই প্রকাশনাটির সর্বস্বত্ত লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত। এই প্রকাশনার আংশিক বা সম্পুণাংশ অন্য যেকোন মিডিয়াতে লেখকের নামে ছাড়া অন্য কারও নামে প্রকাশ করা কপিরাইট আইন এ দন্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গন্য হবে।...

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমুহ

    Recent Comments