shofiq.com

শানে মাওলা আলী (আ.): বেলায়েত ও মারিফাতের বিশ্লেষণ

ভূমিকা: আলী (আ.)—বেলায়েত ও মারিফাতের কেন্দ্রবিন্দু

হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) শুধু ইসলামের চতুর্থ খলিফা বা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জামাতা নন; শিয়া মতাদর্শে তিনি প্রথম ইমাম, রাসূলের (সা.) আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী এবং সুফিবাদে তিনি প্রায় সকল সিলসিলার আধ্যাত্মিক প্রধান (মাওলা)। শিয়া ও সুফি উভয়েই তাঁর ব্যক্তিত্বে ‘জুলফিকারের জেহাদ’ (বাহ্যিক সংগ্রাম) এবং ‘নফসের জেহাদ’ (আভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধি)—এই দুইয়ের সমন্বয় দেখেন।

১. লা ফাতা ইল্লা আলী লা সাইফা ইল্লা জুলফিকার (আলী ব্যতীত কোনো বীর নেই, জুলফিকার ব্যতীত কোনো তরবারি নেই)

এই উক্তিটি ঐতিহাসিক উহুদের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বর্ণিত।

  • ঐতিহাসিক ও হাদিসের দলিল: বহুল প্রচলিত বর্ণনায় বলা হয়, উহুদের যুদ্ধে যখন কাফেররা রাসূলকে (সা.) ঘিরে ফেলেছিল, তখন আলী (আ.) অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করে রাসূলকে (সা.) রক্ষা করেন। এ সময় জিব্রাইল (আ.) অথবা গায়েবী (অদৃশ্য) আওয়াজ আসে: “লা ফাতা ইল্লা আলী লা সাইফা ইল্লা জুলফিকার।” (ইমাম তাবারী-এর ‘তারিখ’ এর কিতাব আত্ তাবারী)
  • শিয়া/সুফি ব্যাখ্যা: এটি আলীর (আ.) শ্রেষ্ঠত্ব (আফলিয়াত) এবং আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তাঁর বিজয়ের অনিবার্যতার ঘোষণা। জুলফিকার এখানে শুধু একটি অস্ত্র নয়, বরং আল্লাহ্‌র ন্যায়বিচার (আদল) এবং সত্য প্রতিষ্ঠার ঐশী প্রতীকী শক্তি। এই শক্তি কেবল ‘ফাতা’ (সাহসী/যুবক) অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ মুমিন আলীর (আ.) হাতেই শোভা পায়, যিনি বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ উভয় শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে সক্ষম।

২. আলী (العلي) ও বেলায়েত (Wilayah): আধ্যাত্মিক উচ্চতা

আমাদের এই প্রবন্ধে ‘আলা’ (আয়ত্বে না থাকা/আমিত্বের লা-অবস্থা) এবং ‘আলী’ (উচ্চ/ঊর্ধ্ব) শব্দের মাধ্যমে যে আধ্যাত্মিকতার কথা বলা হয়েছে, তা বেলায়েত বা অলিত্বের ধারণার সাথে সম্পর্কিত।

  • কোরআনের দলিল: আয়াত আল-বেলায়েত (সূরা আল-মায়িদাহ ৫:৫৫):
  • “তোমাদের বন্ধু (ওয়ালী) তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং মুমিনগণ যারা বিনীতভাবে সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়।”
  • তাফসীর ও শানে নুযূল (অবতীর্ণ হওয়ার কারণ): শিয়া এবং সুন্নিদের কিছু প্রধান তাফসীর মতে, এই আয়াতটি আলী (আ.)-এর শানে অবতীর্ণ হয় যখন তিনি রুকু অবস্থায় একজন অভাবীকে নিজের আংটি দান করেছিলেন।
  • শিয়া ব্যাখ্যা: এই আয়াত আলীকে (আ.) রাসূলের (সা.) পর উম্মাহর ওয়ালী (অভিভাবক/নেতা) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ‘বেলায়েত’ শুধু আধ্যাত্মিক নয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও অন্তর্ভুক্ত করে। আলী (আ.) ছিলেন ‘আলা’ (উচ্চ) কারণ তিনি বস্তুজগতের সকল মোহের ঊর্ধ্বে (লা-অবস্থা) অবস্থান করে আল্লাহর রাস্তায় দান করেছিলেন।
  • হাদিসের দলিল: গাদীরে খুমের ঘটনা:

রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজের পর গাদীরে খুম নামক স্থানে আলী (আ.)-কে সকলের সামনে তুলে ধরে বলেন: “মান কুনতু মাওলাহু ফা-আলীউন মাওলাহু। আল্লাহুম্মা ওয়ালি মান ওয়ালাহু ওয়া আদি মান আদাহ।”

  • তাৎপর্য: শিয়া ও সুফি উভয়ই ‘মাওলা’ শব্দটিকে আলীর (আ.) আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব ও নৈকট্যের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে। শিয়ারা এটিকে ইমামত ও খিলাফতের ভিত্তি মনে করে, আর সুফিরা এটিকে ‘শেখ’ (আধ্যাত্মিক নেতা) হিসেবে আলীর (আ.) উচ্চ মর্যাদার দলিল মনে করে, যার মাধ্যমেই সুফিবাদ বা ইরফান বিকশিত হয়েছে।

৩. মুর্তজা (المُرْتَضَى) ও বদরুদ্দোজা (অন্ধকারের পূর্ণচন্দ্র): কামেল গুরুর পূর্ণতা

আমাদেরে এই প্রবন্ধে ‘কামেল গুরু’-র যে ধারণা দেওয়া হয়েছে, তা সুফিবাদে মানুষে কামিল (পূর্ণ মানব)-এর সমতুল্য। আলী (আ.)-কে এই পূর্ণতার এক আদর্শ মনে করা হয়।

  • মুর্তজা (আল্লাহ্‌র সন্তুষ্ট): এই উপাধি ইঙ্গিত করে যে আলী (আ.) আল্লাহ্‌র রেযা (সন্তুষ্টি) অর্জন করেছেন। এটি তাঁর জীবনের প্রতিটি কাজ, বিশেষত তাঁর জেহাদে আকবর (নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম)-এর চূড়ান্ত সাফল্যের প্রতীক।
  • বেলায়েতের পরিপূর্ণতা ও বদরুদ্দোজা: শিয়া ও সুফি দর্শনে বেলায়েতের চরম স্তরকে ‘বদরুদ্দোজা’ (অন্ধকারের পূর্ণচন্দ্র) বলা হয়।
  • ব্যাখ্যা: এর অর্থ হলো—এমন ব্যক্তিত্ব যিনি আধ্যাত্মিক অজ্ঞতা, বস্তুজগত ও নফসের অন্ধকারের মধ্যেও পূর্ণ নূর (আলো) দ্বারা উদ্ভাসিত। আলী (আ.) ছিলেন এই জ্ঞানের ‘পূর্ণচন্দ্র’, যিনি রাসূলের (সা.) নূর থেকে সরাসরি জ্ঞান লাভ করে উম্মাহর মধ্যে বিতরণ করেছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন: “আনা মাদীনাতুল ইলম ওয়া আলীউন বাবুহা” (আমি জ্ঞানের নগরী, আর আলী তার দরজা)।

৪. অজহুল্লাহ (وَجْهُ اللهِ – আল্লাহর চেহারা/মুখমণ্ডল): ফানা ও বাক্বা

‘অজহুল্লাহ’ উপাধিটি সুফি মারিফাতের (ঐশী জ্ঞান) সবচেয়ে গভীরতম স্তরকে নির্দেশ করে, যেখানে সাধক ফানা ফিল্লাহ (আল্লাহ্‌তে বিলীন) হয়ে বাক্বা বিল্লাহ (আল্লাহ্‌র মাধ্যমে স্থায়িত্ব) অর্জন করেন।

  • হাদিসে কুদসীর ভিত্তি:
  • আল্লাহ্‌ বলেন: “আমার বান্দা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকে, অবশেষে আমি তাকে ভালোবাসি। যখন আমি তাকে ভালোবাসি, তখন আমি তার কান হয়ে যাই যা দ্বারা সে শোনে, তার চোখ হয়ে যাই যা দ্বারা সে দেখে, তার হাত হয়ে যাই যা দ্বারা সে ধরে, এবং তার পা হয়ে যাই যা দ্বারা সে হাঁটে।” (সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিস নম্বর: ৬৫০২)
  • সুফি/শিয়া ব্যাখ্যা: ‘অজহুল্লাহ’ উপাধিটি ইঙ্গিত করে যে আলী (আ.) এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন, যেখানে তাঁর সত্তা থেকে মানবীয় প্রবৃত্তি (গায়রাল্লাহ) অবলুপ্ত হয়েছে এবং তাঁর ইন্দ্রিয়গুলো আল্লাহ্‌র গুণে (সিফাতে ইলাহী) প্রকাশিত হয়েছে। এই স্তরে সাধকের ইচ্ছা আল্লাহ্‌র ইচ্ছার সাথে মিশে যায়। তিনি যা ধরেন বা যা দেখেন, তা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকেই হয়। এই অবস্থাই হলো “আল্লাহর স্বভাবের দ্বারা স্বভাবান্বিত” হওয়া, যার চূড়ান্ত প্রকাশ আলী (আ.)-এর ব্যক্তিত্বে পরিলক্ষিত।

৫. নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ: জেহাদে আকবর

হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রহ.)-এর উক্তিটি, যেখানে আলী (আ.) দু’খানি তরবারি দিয়ে যুদ্ধ করতেন—একটি নফসের বিরুদ্ধে, অন্যটি কাফেরদের বিরুদ্ধে—তা সুফিবাদের প্রধান স্তম্ভ।

  • হাদিসের ভিত্তি: তাবুক যুদ্ধ থেকে ফেরার পর রাসূল (সা.) সাহাবাদের বলেছিলেন: “আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে ফিরলাম।” সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন: “হে আল্লাহ্‌র রাসূল, বড় জিহাদ কোনটি?” তিনি বললেন: “নফসের সাথে জিহাদ।”
  • তাৎপর্য: আলী (আ.) বাহ্যিক জুলফিকারের যুদ্ধে ছিলেন শ্রেষ্ঠতম, কিন্তু সুফিরা তাঁকে ‘নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ (লা-অবস্থা বা আমিত্বের বিনাশ) প্রতীক হিসেবে সর্বোচ্চ স্থানে বসান। এই আভ্যন্তরীণ পবিত্রতা (তাযকিয়াতুন নফস) তাঁকে ‘মুর্তজা’ ও ‘অজহুল্লাহ’ উপাধির উপযুক্ত করে তোলে এবং জুলফিকারের মতো অলৌকিক অস্ত্র ব্যবহারের মর্যাদা প্রদান করে।

উপসংহার

শিয়া মতবাদ এবং সুফিজম হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-কে শুধু একজন ঐতিহাসিক নেতা হিসেবে নয়, বরং ঈমান, আধ্যাত্মিকতা এবং বেলায়েতের এক অতুলনীয় মডেল হিসেবে দেখে। কোরআনের ‘আয়াত আল-বেলায়েত’ এবং হাদিসের ‘গাদীরে খুম’-এর মতো দলিলগুলো তাঁর ‘মাওলা’ ও ‘ওয়ালী’ মর্যাদার ভিত্তি স্থাপন করে।

তাঁর উপাধিগুলি—আলী (উচ্চ), মুর্তজা (সন্তুষ্ট), বদরুদ্দোজা (পূর্ণচন্দ্র) এবং অজহুল্লাহ (আল্লাহ্‌র মুখমণ্ডল)—তাঁর আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা এবং নফসের ওপর তাঁর বিজয়ের প্রতীক। তাঁর হাতে জুলফিকারের উপস্থিতি কেবল বাহ্যিক বিজয়ের ইঙ্গিত দেয় না, বরং জিহাদে আকবর ও আসগর—উভয় প্রকার সংগ্রামে তাঁর কামেল গুরু সুলভ যোগ্যতার প্রতিফলন ঘটায়। আলী (আ.) হলেন সেই পরিশুদ্ধ অস্তিত্ব, যিনি সর্বদা সত্যের প্রতীক এবং আল্লাহ্‌র প্রতিনিধি রূপে বিরাজমান।

মোঃ শফিকুল ইসলাম প্রিয়

এই প্রকাশনাটির সর্বস্বত্ত লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত। এই প্রকাশনার আংশিক বা সম্পুণাংশ অন্য যেকোন মিডিয়াতে লেখকের নামে ছাড়া অন্য কারও নামে প্রকাশ করা কপিরাইট আইন এ দন্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গন্য হবে।...

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমুহ

    Recent Comments