প্রথম পর্ব-
অনেকদিন অগের কথা, আমি তখন ফার্মেসী ব্যবসা করতাম। একদিন আমার ফার্মেসীতে একজন ভদ্র মহিলা আসলেন তার বাচ্চাকে নিয়ে গলায় মাছের কাঁটা ফুটে আছে তা বের করে নেওয়ার জন্য। আমার পুরা কনসার্ন ছিল রোগীর দিকে এবং ব্যস্ত ছিলাম গলার কাঁটা বের করার জন্য। কাঁটা বের করে দেওয়ার পরে ভদ্র মহিলা তার বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেলেন। তারা চলে যাওয়ার পর লক্ষ্য করালাম আমার দোকানের দরজায় একজন বৃদ্ধলোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন। পরনে সাদা ধুতি গায়ে সাদা এক্সসাইজ গেঞ্জি, হাতে একটা বাঁশের লাঠি অনেক পুরাতন অথচ মজবুত। লাঠির শেষ মাথায় শুকনো মাটির দাগ এবং হাতে হলে থাকা অংশের মাথায় চুনের ছোপ ছোপ দাগ। মুখের ভিতর পান চিবুচ্ছেন, পানের খয়েরী কষ কিছুটা গালের গালসী দিয়ে বের হয়ে এসছে। খাটো গড়নের গায়ের রং কালো। বয়েসের ভারে ন্যুব্জ হয়ে আছেন। লোকটার দিকে নজর আসতেই জিগ্যেস করলাম চাচার কিছু লাগবে নাকি? মানে চাচাকে আমি ক্রেতা ভেবে ছিলাম, কিন্তু চাচা আসলে দুনিয়াবী কোন ক্রেতা ছিলেন না ছিলেন আধ্যাত্বিক ক্রেতা। চাচা কোনো কথা না বলে পায়ের জুতা খুলে দোকানের ভিতর ঢুকতে চাইলে আমি বললাম জুতা খোলা লাগবে না আপনি ভিতরে আসুন। চাচা লাঠি ভর দিয়ে দোকানের ভিতরের বেঞ্চ এ এসে বসতে বসতে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ডাক্তার বাবু গলার কাঁটা তো বের করলেন মনের কাঁটা কি বের করতে পারেন?
আমি চাচার কথায় কিছুটা চমকে গিয়ে একটু সময় নিয়ে বললাম পুরাপুরি বের করতে পারি না তবে বের করার জন্য হেল্প করতে পারি। কারন মনের কাঁটা ডাক্তার বের করতে পারে না ডাক্তার শুধু মাত্র হেল্প করতে পারে যার কাঁটা তার নিজের বের করতে হয়।
চাচা হয়তো আশা করেননি আমি এতটুকু বলি তাই তিনিও কিছুটা চমকিত হয়ে এবং কিছুটা নির্লিপ্ত ভাবে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন মনের কাঁটা কি বুঝতে পেরেছেন তো?
চাচা খুব সুন্দর করে ভারতীয় শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন। উনার বেশ ভুষা বলে উনি সনাতন ধর্মীয়।
আমি খুব শান্তভাবে জবাব দিলাম, চাচা আপনার নিজের মনের কাঁটা তো এখনো রয়ে গেছে। তাহলে আপনি কীভাবে বুঝবেন যে আমি জানি কি না জানি?
চাচা একটুও রাগ করলেন না এবং ভাবলেশহীন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, যেন উত্তরটি উনার শোনাই লাগবে।
আমি বললাম, মানুষের মনের সবচেয়ে বড়ো কাঁটা হলো কাউকে সন্দেহ করা। দ্বিতীয় যে বড়ো কাঁটা রয়েছে তা হল অন্যকে ইর্ষা করা আর তৃতীয় কাঁটা হল অহংকার করা। আর আহংকার এমন এক কাঁটা যা মানুষকে ধ্বংস করে দেয় যেমন ধ্বংস করে দেয় আগুন শুকনো কাঠকে।
এবার চাচা যেন কিছুটা লজ্জা পেলেন কিন্তু তারপরও বললেন, মনের আরও অনেক কাঁটা আছে যা নিয়ে আমরা আসলে কখনোই ভাবী না।
কোনো রকম সংকোচ না করে বললাম, অথচ আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে ভাবতে বলেছেন। শিখতে বলেছেন। আমরা না শিখে অন্যের শেখানো কথা আওড়িয়ে যাচ্ছি।
মনের অন্যন্য যে কাঁটা রয়েছে তা এক এক করে চাচাকে জানালাম-
১। কাম, ২। ক্রোধ, ৩। লোভ, ৪। মোহ, ৫। হিংসা, ৬। বকধার্মিকতা (লোক দেখানো ধর্ম পালন), ৭। প্রদর্শন বাতিক, ৮। রাগ, ৯। দুশ্চিন্তা, ১০। উচ্চাকাঙ্খা ইত্যাদি।
এবার চাচার মুখটা যেন কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। উনি খুশিতে বলে উঠলেন আধ্যাতিকতা বুঝতে হলে তার ভিতর কিছুটা আধ্যাতিকতা থাকা লাগে। বাবা অনেক কথা হল আজ উঠি হয়ত আবার দেখা হবে। চাচা উঠে দাঁড়ালে আমি বললাম, চাচা এ-ই যে আপনি বললেন হয়ত আবার দেখা হবে, এটাও একটি আধ্যাতিকতার কারন আমরা কেউই জানি না কার সাথে আবার কখন দেখা হবে, আদেও দেখা হবে কিনা।
চাচা মৃদু হাসতে হাসেত লাঠিভর দিয়ে হাটতে হাটতে চলে যাচ্ছেন আর আমি তাকিয়ে রইলাম। সেদিন থেকেই মনে মনে আমার একটি আকাংক্ষা তৈরী হয় মনের কাঁটা খুলবার অর্থাৎ নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কৌশল এর উপর একটি বই লেখার। জানিনা কতটুকু সফল বা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছি। আসুন এখন মূল আলোচনায়-
“নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ: কুরআন ও হাদীসের আলোকে আত্মসংগ্রাম” এই বইটিতে আত্মার বা নাফসের সাথে লড়াইয়ের ধারণা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পেয়েছি, সফল হয়েছি কিনা বিচার করার দাবি রইল আপনাদের উপর। নিজের ইচ্ছা ও তাড়না নিয়ন্ত্রণের এই অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ ইসলামি শিক্ষার গভীরে প্রোথিত, যা আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং আত্মশুদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
‘নাফস্’ বা আত্মাকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়েছেঃ ‘‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’হ্’ (আদেশদানকারী নাফস্), ‘‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’হ্’ (ভর্ত্সনাকারী নাফস্), এবং ‘নাফস্ আল-মুতমাইন্নাহ্’ (প্রশান্ত বা শান্তিপূর্ণ নাফস্)। কুরআন ও হাদীস নাফসের ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণে ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং নৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার উপর গুরুত্ব দিয়ে গভীর নির্দেশনা প্রদান করবে ইনশাআল্লাহ্।
বইটিতে ইসলামি পণ্ডিতদের শিক্ষাসমূহ, কুরআনিক আয়াত এবং নবীজির নির্দেশনা থেকে উদাহরণ টেনে, নাফসের চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তার জন্য ব্যবহারিক পরামর্শ প্রদান করার চেষ্টা করেছি। এতে প্রতিদিনের অভ্যাসগুলোর মধ্যে রোজা রাখা, নামাজ পড়া এবং দানশীলতা কার্যকরী উপায় হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, যা আত্মশুদ্ধির জন্য অপরিহার্য। এই দীর্ঘ আত্মসংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল নিজেকে ইসলামিক নীতিগুলোর সাথে সামঞ্জস্য করা, আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা এবং একটি শান্তিপূর্ণ, ধার্মিক আত্মা বজায় রাখা; সর্বপরি আত্নশুদ্ধি অর্জন করা।
এই ব্যাপক নির্দেশিকা পাঠকদেরকে আধ্যাত্মিক যাত্রা গ্রহণে উৎসাহিত করার পাশাপাশি আধুনিক জীবনের বিভ্রান্তি ও চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলায় ইসলামি শিক্ষার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা অর্জন করার তৌফিক আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা প্রদান করুন। এলাহী আমিন।
নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধঃ কুরআন ও হাদিসের আলোকে আত্মসংগ্রাম
সুচিপত্রঃ
প্রথম অধ্যায়ঃ ইসলামে নাফসের ধারণা
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ তিন প্রকার নাফস্ঃ ‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’, ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্ ও ‘নাফস্ আল-মুতমাইন্নাহ্’
তৃতীয় অধ্যায়ঃ কুরআনে জিহাদুল নাফসের গুরুত্ব
চতুর্থ অধ্যায়ঃ জিহাদুল নাফস্ সম্পর্কিত হাদিস থেকে অন্তর্দৃষ্টি
পঞ্চম অধ্যায়ঃ অন্তর্যুদ্ধঃ অন্তর্নিহিত সংগ্রাম অনুধাবণ
ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ নাফস্ নিয়ন্ত্রণে তাকওয়ার ভূমিকা
সপ্তম অধ্যায়ঃ অন্তরকে পরিশুদ্ধ করাঃ নাফস্ কে জয় করার চাবিকাঠি
অষ্টম অধ্যায়ঃ নাফসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বাস্তব কৌশল
নবম অধ্যায়ঃ নাফস্ দূরীকরণে সালাত, রোযা ও যিকিরের ভূমিকা
দশম অধ্যায়ঃ নাফসের উপর পরিবেশ ও সঙ্গীর প্রভাব
একাদশ অধ্যায়ঃ নবী ও সাহাবীদের জীবনী থেকে উদাহরণ
দ্বাদশ অধ্যায়ঃ নাফসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কৃতজ্ঞতা ও ধৈর্যের ভূমিকা
ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ নাফসের মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক মাত্রা
চতুর্থদশ অধ্যায়ঃ নাফস্ জয়ের ফলঃ আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি ও প্রশান্তি
পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ উপসংহারঃ নিরন্তর সংগ্রাম ও আল্লাহর হেদায়েত কামনা
ভূমিকাঃ
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যা কেবল বাহ্যিক কাজের ওপরই নয়, আত্মার অভ্যন্তরীণ অবস্থার উপরও গুরুত্বারোপ করে। একজন মুসলমানকে যে গভীরতম অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম—যা আত্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আরবিতে, নাফস্ বলতে আত্মা, নিজ সত্তা বা অহংকার বোঝানো হলেও, এটি মূলত মানবজাতির সেই অন্তর্নিহিত দিককে নির্দেশ করে যা মানুষকে লালসা, পার্থিব প্রলোভন ও আল্লাহর স্মৃতি বা স্মরণ থেকে গাফেল করে দেয়। এই সংগ্রাম, যা জিহাদ আল-নাফস্ নামে পরিচিত, এটি একটি আজীবন চলমান সংগ্রাম এবং ইসলামে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিহাদগুলির মধ্যে একটি।
কোরআনে, নাফস্ কে তিন প্রকারে বর্ণনা করা হয়েছেঃ ‘‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’’ (প্রধানত খারাপ কাজের দিকে প্ররোচিত আত্মা), ‘‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’’ (নিজের ভুলত্রুটির জন্য নিজেকে ধিক্কার দেওয়া আত্মা) এবং ‘‘নাফস্ আল মুতমাইন্নাহ’’ (প্রশান্ত আত্মা)। এগুলি মানুষের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করার বিভিন্ন স্তরকে উপস্থাপন করে এবং মানুষের আত্মার আধ্যাত্মিক যাত্রার জন্য একটি কাঠামো প্রদান করে। যেখানে ‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ মানুষকে পাপ ও অবাধ্যতার দিকে পরিচালিত করে, ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’ নিজের ত্রুটিগুলোর জন্য নিজেকে তিরস্কার করে এবং ‘নাফস্ আল মুতমাইন্নাহ’ হলো সেই আত্মার অবস্থা যা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে শান্তি এবং শক্তি খুঁজে পায় মূলত আল্লাহ’তে বিলিন হওয়াই এই আত্নার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য।
আমাদের প্রিয় রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শিখিয়েছেন যে, সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ হলো নিজের বিরুদ্ধে লড়াই করা। এটি এমন একটি জিহাদ যা প্রতিটি মানুষকে প্রতিদিন মোকাবেলা করতে হয়। এটি এমন একটি সংগ্রাম যেখানে একজন মানুষ তার ইচ্ছাকে আল্লাহর আদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা করে এবং আত্মকেন্দ্রিকতা, অহংকার ও পাপের দিকে ঝোঁককে অতিক্রম করে। হাদিসে আমরা অসংখ্যবার নাফস্ কে আয়ত্ত করার গুরুত্বের উল্লেখ পাই। আমাদের প্রিয় রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একবার যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তার সাহাবিদের বলেছিলেন, “আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে ফিরে এসেছি, অর্থাৎ নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদ।” এই বক্তব্যটি নাফস্ কে মোকাবেলা করার এবং আত্মাকে পবিত্র করার আধ্যাত্মিক তাৎপর্যকে তুলে ধরে।
এই বই, “নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধঃ কোরআন ও হাদিসের আলোকে আত্মসংগ্রাম” এই গভীর অভ্যন্তরীণ যুদ্ধটি কে নিয়ে বিশ্লেষণ করে এবং মুসলমানদের জন্য আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির পথে একটি রোডম্যাপ সরবরাহ করার প্রয়াস পাব। কোরআন এবং আমাদের প্রিয় রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর শিক্ষার আলোকে আমরা নাফসের প্রকৃতি, এর পরিশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা এবং এই অভ্যন্তরীণ সংগ্রামে লড়াই করার বাস্তব কৌশলগুলি নিয়ে আলোচনা করব। এটি স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ যে জিহাদ আল-নাফস্ একটি একক ঘটনা নয় বরং এটি একটি চলমান যাত্রা, যা ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং আল্লাহর দিকনির্দেশনার ওপর নির্ভরশীলতা প্রয়োজন।
‘জিহাদ আল-নাফসের’ গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দেয় এই সত্য যে একজন ব্যক্তির আত্মার অবস্থা আল্লাহর নিকট তার অবস্থান নির্ধারণ করে। এমন একটি আত্মা যা ‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ দ্বারা প্রভাবিত—যা খারাপ কাজের দিকে আহ্বান করে—তা পাপের ঝুঁকিতে থাকে, যেখানে ‘নাফস্ আল মুতমাইন্নাহর’ অবস্থায় পৌঁছানো আত্মা চিরকালীন শান্তি খুঁজে পাবে, যেমন আল্লাহ কোরআনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেনঃ
یٰۤاَیَّتُهَا النَّفۡسُ الۡمُطۡمَئِنَّۃُ ﴿٭ۖ۲۷﴾
ارۡجِعِیۡۤ اِلٰی رَبِّكِ رَاضِیَۃً مَّرۡضِیَّۃً ﴿ۚ۲۸﴾
فَادۡخُلِیۡ فِیۡ عِبٰدِیۡ ﴿ۙ۲۹﴾
وَ ادۡخُلِیۡ جَنَّتِیۡ ﴿۳۰﴾
“হে (তুমি) প্রশান্ত আত্মা! তোমার পালনকর্তার দিকে ফিরে এসো, তুমি সন্তুষ্ট ও সন্তোষজনক অবস্থায়! আমার (সম্মানিত) বান্দাদের মধ্যে প্রবেশ করো, এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো!” (সূরা আল-ফজর, ৮৯:২৭-৩০)
এই বইতে আমরা নাফসের বিভিন্ন দিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এর প্রভাব নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করব। আমরা কীভাবে কোরআন ও হাদিস ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করতে, অহংকারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং বিনয় বজায় রাখতে নির্দেশনা প্রদান করে তা অন্বেষণ করব। তাছাড়া, আমরা কীভাবে একজন মুমিন আল্লাহর প্রতি সচেতনতা (‘তাকওয়া’ বা আল্লাহ ভীতি) বাড়াতে পারেন, আল্লাহর স্মরণ (‘জিকির’) নিয়ে নিয়মিত থাকতে পারেন এবং আত্মবিশ্লেষণ ও আত্ম-শৃঙ্খলার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন সেই বাস্তব পদক্ষেপগুলো নিয়েও আলোচনা করব। চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ‘নাফস্ আল মুতমাইন্নাহর’ অবস্থায় পৌঁছানো—একটি আত্মা যা নিজের সঙ্গে শান্তিতে থাকে এবং আল্লাহর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।
এই অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ কেবল আলেম বা সাধুদের জন্য নয়। এটি এমন একটি সংগ্রাম যা প্রতিটি মুসলমানকে মোকাবেলা করতে হয়। এটি হোক লোভের বিরুদ্ধে, রাগ, অলসতা, অথবা অহংকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, প্রতিটি ব্যক্তির নিজ নিজ চ্যালেঞ্জ থাকে। তবে আন্তরিক প্রচেষ্টা, দোয়া এবং আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতার মাধ্যমে, নাফসের বিরুদ্ধে বিজয় সম্ভব এবং তা অত্যন্ত পুরস্কৃত। এই বইটি আপনাকে এই আত্ম-পরিশুদ্ধির যাত্রায় প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও সরঞ্জাম সরবরাহ করতে স্বচেষ্ট।
কুরআন ও হাদীস থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে, এবং নবী ও নেককার পূর্বসূরীদের উদাহরণ অনুসরণ করে, আমরা কিভাবে ‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’ এর প্রলোভন প্রতিরোধ করতে পারি এবং আত্মিক উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারি, তা অনুসন্ধান করব। নাফস্ এর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধটি আমাদের সকলের লড়াই করতে হবে, যদি আমরা এই জীবন এবং আখেরাতে সত্যিকারের সফল হতে চাই।
অধ্যায় ১। ইসলামে নাফসের ধারণা
এই অধ্যায়ে, আমরা ইসলামী চিন্তা ও গ্রন্থে নাফস্ এর মৌলিক ধারণা নিয়ে আলোচনা করব। আমরা এই শব্দটির ভাষাগত ও ধর্মতাত্ত্বিক অর্থ বোঝার চেষ্টা করব এবং এটি কীভাবে আমাদের আত্মার ধারণাকে মূল্যায়ীত করে তা অন্বেষণ করব। কুরআনের দৃষ্টিকোণ থেকে, নাফস্ আমাদের আধ্যাত্মিক গঠনের একটি অন্তর্নিহিত অংশ, এবং এর অবস্থা আমাদের আল্লাহর নৈকট্য নির্ধারণ করে। নাফস্ আকাঙ্ক্ষা, পার্থিব আসক্তি এবং বাহ্যিক প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়, তবে এটি এই প্রভাবগুলির ঊর্ধ্বে ওঠার সক্ষমতাও ধারণ করে, যা পরিশুদ্ধির মাধ্যমে সম্ভব।
আমরা আরও আলোচনা করব নাফস্ বা আত্মা ও এর দেহের সাথে সম্পর্ক। মানুষ দুইটি উপাদান নিয়ে গঠিতঃ বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক। নাফস্ এই দুইয়ের সংযোগস্থলে বসে, সবসময় দুটি দিকেই টান অনুভব করে। এই ভারসাম্য বোঝা বইটির বাকি অংশের ভিত্তি স্থাপন করবে এবং পাঠকদের অন্তর্নিহিত সংগ্রামের গভীরতাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে।
অধ্যায় ১। ইসলামে নাফসের ধারণা
নাফসের ভাষাগত ও ধর্মতাত্ত্বিক সংজ্ঞা
আরবীতে, নাফস্ একটি বিস্তৃত শব্দ, যার বিভিন্ন অর্থ রয়েছে—স্ব, আত্মা, অহং বা কোনো ব্যক্তির সম্পূর্ণ অস্তিত্ব। যখন আমরা কুরআন ও হাদীসের প্রেক্ষাপটে যদি নাফস্ এর সংজ্ঞা অন্বেষণ করি, তখন এটি কেবল শারীরিক স্ব বা অহংকার বোঝায় না। বরং এটি একটি গভীর আধ্যাত্মিক উপাদানকে প্রতিফলিত করে, যা আমাদের পৃথিবীর সাথে এবং আমাদের আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার সাথে কীভাবে যোগাযোগ করি তা নির্ধারণ করে।
ধর্মতাত্ত্বিকভাবে, নাফস্ দেহ ও আত্মার মধ্যে একটি সংযোগকারী উপাদান। এটি মানুষের সেই দিক যা আকাঙ্ক্ষা, লোভ এবং পার্থিব ভোগবিলাসের প্রতি ঝুঁকে থাকে, তবে এটি আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সামর্থ্যও ধারণ করে। কুরআনে বিভিন্ন প্রসঙ্গে নাফস্ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যা স্ব বা আত্মার বিভিন্ন দিককে আলোকিত করে। যেমনঃ
اِنَّ اللّٰهَ لَا یُغَیِّرُ مَا بِقَوۡمٍ حَتّٰی یُغَیِّرُوۡا مَا بِاَنۡفُسِهِمۡ
– “নিশ্চয়ই, আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা তাদের নিজেদের নাফস্ (স্ব) পরিবর্তন করে।” (সূরা আর-রা’দ, ১৩:১১)
এই আয়াতটি নাফস্ কে একটি রূপান্তরের মাধ্যম হিসেবে চিত্রিত করে। যখন একজন ব্যক্তি তাদের নাফস্ কে পরিশুদ্ধ এবং পরিমার্জিত করার চেষ্টা করে, তখন তারা কেবল তাদের নিজের ভিতরে নয়, তাদের বাহ্যিক বাস্তবতাতেও পরিবর্তনের দরজা খুলে দেয়।
শরীর, মন এবং আত্মার মধ্যকার যুদ্ধ
নাফস্ এর ধারণা সম্পূর্ণরূপে বুঝতে হলে, আমাদের মানব অস্তিত্বের তিনটি মৌলিক উপাদানকে জানতে বা বুঝতে হবেঃ শরীর, মন, এবং আত্মা। নাফস্ এদের মধ্যে চলাচল করে, যা প্রায়শই পরস্পরবিরোধী আকাঙ্ক্ষার জন্য একটি যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে ওঠে।
১। ‘‘শরীর” বস্তুগত সন্তুষ্টির জন্য আকাঙ্ক্ষা করে—খাবার, পানীয়, বিশ্রাম এবং আরাম। শরীরের চাহিদা বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয়, তবে যদি নিয়ন্ত্রণহীন হয়, তবে তা অতিরিক্ততায় পরিণত হতে পারে।
২। ‘‘মন” হলো বুদ্ধিবৃত্তিক দিক, যা যুক্তি এবং বিচারক্ষমতার জন্য দায়ী। এটি শরীরের আকাঙ্ক্ষাগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে এবং নৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। তবে অহংকার বা দাম্ভিকতার দ্বারা প্রভাবিত হলে মনও দূষিত হতে পারে।
৩। ‘‘আত্মা” আধ্যাত্মিক উপাদান, যা আল্লাহর নৈকট্য খুঁজতে তৈরি হয়েছে। আত্মা একজনকে ভালোর দিকে, নৈতিকতার দিকে এবং ইবাদতের দিকে আহ্বান জানায়। এটি সেই অংশ যা আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে কেবল শান্তি ও সন্তুষ্টি পেতে চায়।
নাফস্ এই তিনটি উপাদানের সংযোগস্থলে অবস্থান করে। এটি শরীরের আকাঙ্ক্ষাগুলির টান অনুভব করে, তবে এটি আত্মার বিশুদ্ধতা এবং আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণের প্রবণতার প্রতিও সচেতন। এই অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনই নাফস্ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধকে ইসলামে এত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। একজনকে অবশ্যই এই যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে যেতে হবে এবং তাদের বস্তুগত চাহিদা এবং আধ্যাত্মিক লক্ষ্যগুলির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে শিখতে হবে।
নাফসের স্তরসমূহঃ ‘নাফস্ আল-আম্মারাহ্’, ‘নাফস্ আল-লাওয়ামাহ্’ এবং ‘নাফস্ আল-মুতমাইন্নাহ্’
ইসলামী চিন্তায়, নাফস্ কে এর বিকাশ এবং আল্লাহর দিকনির্দেশনার প্রতি এর আত্মসমর্পণ অনুসারে তিনটি পৃথক স্তরে বা পর্যায়ে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। এই স্তরগুলো ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক বিকাশের জন্য একটি রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করে এবং আমাদের আত্মশুদ্ধির পথে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি তা বোঝার জন্য অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
(চলবে-)
মন্তব্য করুন