shofiq.com
কোরআন ও হাদিসের আলোকে আধুনিক জীবনে ইসলামী মূল্যবোধের প্রাসঙ্গিকতা

কোরআন ও হাদিসের আলোকে আধুনিক জীবনে ইসলামী মূল্যবোধের প্রাসঙ্গিকতা

আধুনিক জীবন একদিকে যেমন সুযোগ-সুবিধায় পরিপূর্ণ, তেমনি অন্যদিকে জটিলতা ও অস্থিরতায় ভরা। প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ, সামাজিক পরিবর্তন এবং বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মানুষের মূল্যবোধকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নের মুখে ফেলছে। এই প্রেক্ষাপটে কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত ইসলামী মূল্যবোধের প্রাসঙ্গিকতা আগের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইসলাম এমন এক জীবনবিধান যা ১৪০০ বছর পরেও মানবজাতির জন্য আলোর দিশারী, কারণ এর মূলনীতিগুলো সর্বকালে ও সর্বযুগে প্রযোজ্য।
ব্যক্তি জীবনে ইসলামী মূল্যবোধের প্রভাব
আধুনিক সমাজে ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা বাড়ছে, যা মানুষের মধ্যে একাকীত্ব এবং মানসিক অস্থিরতা তৈরি করছে। ইসলামী মূল্যবোধ এই শূন্যতা পূরণে সহায়ক।
* আল্লাহর সাথে সম্পর্ক (তাওহীদ): কোরআনের মূল বার্তা হলো এক আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস (তাওহীদ)। এই বিশ্বাস মানুষকে জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয় এবং সকল সংকটে আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে শেখায়। আধুনিক জীবনের ভোগবাদী চিন্তা যখন মানুষকে হতাশ করে, তখন তাওহীদ মানুষকে প্রকৃত শান্তি ও স্থিরতা দান করে। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহকে প্রভু, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মাদকে (সা.) রাসুল হিসেবে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছে, সে ঈমানের স্বাদ পেয়েছে।” (সহীহ মুসলিম)।
* নৈতিকতা ও চরিত্র গঠন: সততা, ন্যায়পরায়ণতা, ধৈর্য, ক্ষমা এবং বিনয়—এগুলো ইসলামী মূল্যবোধের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আধুনিক সমাজে যেখানে দ্রুত অর্থ উপার্জন এবং স্বার্থপরতা প্রবল, সেখানে এই মূল্যবোধগুলো মানুষকে সৎ পথে চলতে এবং উন্নত চরিত্র গঠন করতে উৎসাহিত করে। কোরআনে বলা হয়েছে, “আর অবশ্যই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।” (সূরা আল-কালাম: ৪) এই আয়াত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ চরিত্রের কথাই তুলে ধরে।
* শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য: ইসলামে হালাল-হারামের বিধান, পরিচ্ছন্নতা এবং সুষম খাদ্যাভ্যাসের নির্দেশনা রয়েছে। আধুনিক জীবনে যেখানে ফাস্টফুড এবং অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, সেখানে ইসলামী জীবনবিধান মানুষকে সুস্থ জীবনযাপনে উৎসাহিত করে। পাশাপাশি, নামাজ, যিকির ও দোয়ার মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়, যা আধুনিক জীবনের মানসিক চাপ মোকাবেলায় অত্যন্ত কার্যকরী।
সামাজিক জীবনে ইসলামী মূল্যবোধের প্রাসঙ্গিকতা
পরিবার থেকে শুরু করে বৃহত্তর সমাজ পর্যন্ত ইসলামী মূল্যবোধগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে অপরিহার্য।
* পারিবারিক বন্ধন: আধুনিকতার প্রভাবে পারিবারিক কাঠামো দুর্বল হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে অধিকার ও দায়িত্বের ভারসাম্যহীনতা বাড়ছে। ইসলাম পরিবারকে সমাজের মূল ভিত্তি হিসেবে দেখে এবং সদস্যদের পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন: “তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা একমাত্র তাঁর ইবাদত করো এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো।” (সূরা আল-ইসরা: ২৩)।
* সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্য: ইসলামে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করতে যাকাত ও সাদাকার বিধান রয়েছে। এটি সামাজিক সংহতি এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। আধুনিক সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে, যা অস্থিরতা তৈরি করছে। ইসলাম এই বৈষম্য কমানোর পথ দেখায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে, যে মানুষের জন্য বেশি উপকারী।” (সহীহ বুসারি)।
* প্রতিবেশী ও মানবতা: ইসলাম শুধু মুসলিমদের মধ্যে নয়, সকল মানুষের প্রতি দয়া ও সহানুভূতির নির্দেশ দেয়। প্রতিবেশীর অধিকার, অসহায়দের প্রতি সাহায্য এবং অমুসলিমদের সাথে সদ্ব্যবহারের শিক্ষা আধুনিক সমাজে শান্তি ও সহাবস্থান নিশ্চিত করে।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
আধুনিক জীবনের কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক মনে হতে পারে। যেমন: নৈতিক অবক্ষয়, ভোগবাদ, তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার ইত্যাদি। তবে, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইসলামী মূল্যবোধই সমাধান দিতে পারে। সঠিক জ্ঞান অর্জন, ইসলামী শিক্ষার প্রচার এবং ব্যক্তিগত জীবনে এর অনুশীলনই পারে আধুনিকতার নামে আসা কুফল থেকে রক্ষা করতে।
উপসংহার
কোরআন ও হাদিসের আলোকে ইসলামী মূল্যবোধগুলো কেবল কিছু ধর্মীয় অনুশাসন নয়, বরং এটি একটি সম্পূর্ণ জীবনদর্শন যা আধুনিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। ব্যক্তি জীবনে শান্তি ও প্রশান্তি আনা, পরিবার ও সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং সর্বোপরি একটি ন্যায়ভিত্তিক ও কল্যাণমূলক সমাজ গঠনে ইসলামী মূল্যবোধের কোনো বিকল্প নেই। এই মূল্যবোধগুলোকে ধারণ ও অনুশীলন করার মাধ্যমেই আমরা একটি উন্নত ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন লাভ করতে পারি, যা ইহকাল ও পরকালে আমাদের সাফল্যের পথ সুগম করবে।

মোঃ শফিকুল ইসলাম প্রিয়

এই প্রকাশনাটির সর্বস্বত্ত লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত। এই প্রকাশনার আংশিক বা সম্পুণাংশ অন্য যেকোন মিডিয়াতে লেখকের নামে ছাড়া অন্য কারও নামে প্রকাশ করা কপিরাইট আইন এ দন্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গন্য হবে।...

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমুহ

    Recent Comments