shofiq.com
Rules and Regulations of Animal Sacrifice on the Occasion of Eid-ul-Adha

ঈদুল-আযহার পশু কোরবানির শর্তাবলী ও নিয়মাবলী: কোরআন ও হাদীসের আলোকে

ভূমিকা:

ঈদুল আজহা, যা কোরবানির ঈদ নামে পরিচিত, ইসলামী ক্যালেন্ডারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি নবী ইব্রাহিম (আঃ)-এর তার পুত্র ইসমাইল (আঃ)-কে আল্লাহর আদেশে কোরবানি দিতে রাজি হওয়ার ঘটনাকে স্মরণ করে। এই উপলক্ষে, বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা পশু কোরবানির মাধ্যমে এই ঘটনার স্মৃতি উদযাপন করে থাকেন। তবে, কোরবানির সময় কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী নির্ধারিত নিয়ম-কানুন জানা এবং তা অনুসরণ করেই পশু কোরবানি দেওয়া অত্যন্ত জরুরি, যাতে তা ইসলামী শরীয়তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

তার আগে, আসুন জেনে নেই পশু জবাইয়ের সময় যেসব শর্ত প্রযোজ্য—

যিনি পশু জবাই করবেন, তিনি মু’মিন ও পরহেযগার হতে হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে না এবং ইসলামের নির্দেশনা অনুসরণ করে না, সে কোরবানির পশু জবাই করার উপযুক্ত নয়। শহরাঞ্চলে প্রায়ই আমরা কোরবানির পশু জবাইয়ের জন্য কসাই ব্যবহার করি, যা সম্পূর্ণ অনুচিত। তবে কসাই যদি মু’মিন ও পরহেযগার হয়, তাহলে সমস্যা নেই।
কোরবানির পশুকে জবাইয়ের আগে যথেষ্ট পানি খাওয়ানো উচিত। পানি না খাইয়ে কখনোই পশু জবাই করা উচিত নয়। এতে দুটি উপকার হয়– এক. আল্লাহর নির্ধারিত পদ্ধতিতে পশু জবাই করা হয় যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে সন্তুষ্ট করে, দুই. জবাইয়ের আগে পানি খাওয়ালে চামড়া সহজে উঠানো যায় এবং মাংসের ভিতরের রক্ত সম্পূর্ণ বের হয়ে যায়।
পানি খাওয়ানোর পর পশুকে ভালোভাবে বেঁধে রাখতে হবে যাতে জবাইয়ের সময় পালাতে না পারে এবং বেঁধে রাখার সময় যেন কষ্ট না পায় তা লক্ষ্য রাখতে হবে।
সঠিকভাবে বেঁধে রাখার পর পশুকে কিবলামুখী করে শোয়াতে হবে।
যে ছুরি দিয়ে জবাই করা হবে তা খুব ধারালো হতে হবে যাতে পশু কষ্ট না পায়।
জবাইয়ের সময় কোরবানির দোয়া ও ‘বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার’ পাঠ করতে হবে। অনেকেই কোরবানির দোয়াকে গুরুত্ব দেন না, যা সঠিক নয়। কোরবানির দোয়া নিচে দেওয়া হলো–

এই দোয়া হযরত আলী (আঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, কোরবানির পশু জবাই করার আগে বলা উচিত:

بِسْمِ اللَّهِ وَ اللَّهُ أَكْبَرُ- وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّماواتِ وَ الْأَرْضَ حَنِيفاً مُسْلِماً وَ مَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ- إِنَّ صَلاتِي وَ نُسُكِي وَ مَحْيَايَ وَ مَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لَا شَرِيكَ لَهُ وَ بِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَ أَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ।

উচ্চারণ: বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস-সামাওয়াতি ওয়াল আর্দ্বা হানিফাম মুসলিমা ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকীন, ইন্না সালাতি ওয়ানুসুকি ওয়ামাহইয়া ওয়ামামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন, লা শরীকা লাহু ওয়া বিযালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমীন।

জবাইয়ের সময় নিম্নলিখিত দোয়া বলা উচিত:

– যদি নিজে নিজের পক্ষ থেকে কোরবানি করেন তবে বলবেন:

اللّهمّ تقبّل منی
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা তাকব্বাল মিন্নী।
(হে আল্লাহ, আমার পক্ষ থেকে কবুল করুন)

– যদি কারো পক্ষ থেকে কোরবানি করেন তবে বলবেন:

اللّهمّ تقبّل منهم
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা তাকব্বাল মিনহুম।
(হে আল্লাহ, তাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন)

– যদি নিজের ও অন্যদের পক্ষ থেকে কোরবানি করেন তবে বলবেন:

اللّهمّ تقبّل منا
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা তাকব্বাল মিন্না।
(হে আল্লাহ, আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন)

আমরা প্রায়ই এক জায়গায় অনেক পশু কোরবানি করি। এজন্য পশুগুলো এমনভাবে রাখতে হবে যাতে একটি পশু অন্য পশুর জবাই দেখা না পায়।
জবাইয়ের সময় প্রধান শিরা এবং আরও কিছু শিরা কেটে দিতে হয় এবং এটি দ্রুত করতে হবে যাতে পশু কষ্ট না পায়।
জবাই সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথেই পশুকে খুলে দিতে হবে।
জবাইয়ের পর পশুটি পুরোপুরি মৃত্যুবরণ করেছে তা নিশ্চিত হওয়ার পর চামড়া তোলা শুরু করতে হবে।

এখন কোরবানির আরও কিছু নিয়ম নিয়ে আলোচনা করা যাক—

কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি

কুরআনে কোরবানি সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটি আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের একটি নিদর্শন। কুরআনে বলা হয়েছে—

لَنۡ یَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوۡمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰکِنۡ یَّنَالُهُ التَّقۡوٰی مِنۡکُمۡ ؕ کَذٰلِکَ سَخَّرَهَا لَکُمۡ لِتُکَبِّرُوا اللّٰهَ عَلٰی مَا هَدٰىکُمۡ ؕ وَ بَشِّرِ الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۳۷﴾

“আল্লাহর নিকট তাদের গোশত এবং রক্ত পৌঁছায় না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের জন্য অনুগত করেছেন যাতে তোমরা আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করো তাঁর প্রদত্ত পথনির্দেশনার জন্য। আর আপনি শুভ সংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদের।” (সূরা আল-হাজ্জ: ৩৭)

এই আয়াতটি নির্দেশ করে যে, কোরবানির মূল তাৎপর্য মাংস বা রক্তে নয়, বরং কোরবানিদাতার অন্তরের খোঁজ নেওয়ায়। পাশাপাশি অপচয় বা বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকার নির্দেশও এতে অন্তর্ভুক্ত।

হাদীস ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা

রাসূলুল্লাহ (সা.) কোরবানির গুরুত্ব ব্যক্ত করেছেন ও নিজেও তা পালন করেছেন। হাদীস অনুযায়ী, কোরবানির পশু নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবান, নির্দোষ ও ভালো পশু বেছে নেওয়া উচিত। কোরবানির সময় পশুর প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল হওয়া আবশ্যক। নবী করিম (সা.) বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে উত্তমভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই যখন তোমরা হত্যা করো তখন ভালোভাবে হত্যা করো; যখন তোমরা জবাই করো তখন ভালোভাবে করো। তোমাদের প্রত্যেকেই যেন তার ছুরি ধারালো করে এবং পশুকে কষ্ট না দেয়।” (সহীহ মুসলিম)

কোরবানির নিয়মাবলি:

নিয়ত: কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ এবং তাঁর আদেশ পালনে নিজেকে উৎসর্গ করা। আত্মপ্রদর্শন, প্রতিযোগিতা বা লোক দেখানো উদ্দেশ্যে কোরবানি করা উচিত নয়।
পশু নির্বাচন: নির্দিষ্ট বয়স, স্বাস্থ্য এবং দোষত্রুটি মুক্ত পশু নির্বাচন করা বাধ্যতামূলক।
জবাই প্রক্রিয়া: জবাই অবশ্যই মানবিক ও সম্মানজনক পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতে হবে। ধারালো ছুরি ব্যবহার করা এবং দ্রুত ও নিখুঁতভাবে শিরা কাটতে হবে যাতে পশুর কষ্ট না হয়।
মাংস বিতরণ: কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করা উচিত—এক ভাগ নিজের বা পরিবারের জন্য, এক ভাগ আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের জন্য, এবং এক ভাগ গরিব-দুঃস্থদের জন্য। এতে সমাজে সংহতি ও দানশীলতার চর্চা হয়।
পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি: যারা কোরবানিতে অংশগ্রহণ করে, তাদের ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত।

কোরবানিকারীর সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক—

কোরবানি করা একজন ব্যক্তির ঈমান, চরিত্র ও আধ্যাত্মিকতার পরিচয় বহন করে। কুরআন ও হাদীস থেকে জানা যায় যে, একজন প্রকৃত কোরবানিকারী যেসব গুণে গুণান্বিত—

ঈমান ও আনুগত্য: কোরবানিকারী ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি গভীর ঈমান ও আনুগত্যে পরিপূর্ণ থাকে। সে কোরবানিকে ইবাদতের একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এবং আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য এটি সম্পন্ন করে।
সদাচরণ ও পরহেযগারি: একজন কোরবানিকারী ন্যায়পরায়ণ ও ধার্মিক ব্যক্তি, যিনি ইসলামের নীতিমালা অনুসরণ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণে জীবন পরিচালনা করেন।
দয়া ও সহানুভূতি: সে পশুর প্রতি দয়াশীল এবং সহানুভূতিশীল আচরণ করে, সঠিকভাবে তাদের যত্ন নেয় এবং কোরবানির সময় কষ্ট না হয় তা নিশ্চিত করে।
নম্রতা ও বিনয়: সে কোরবানিকে গর্ব বা লোক দেখানোর বিষয় হিসেবে নেয় না; বরং বিনয়ী মনোভাব নিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজটি সম্পন্ন করে।
দানশীলতা ও উদারতা: কোরবানির মাংস বিতরণের মাধ্যমে সে সমাজে দানশীলতা ও সহমর্মিতার পরিচয় দেয়।
ধৈর্য ও অধ্যবসায়: কোরবানি সম্পন্ন করতে ধৈর্য ও দৃঢ়তা প্রয়োজন হয়, যা একজন প্রকৃত মুমিনের গুণ।

শেষ কথা—

ঈদুল আজহার কোরবানির নিয়ম ও বিধান কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহর ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত। মুসলমানদের উচিত এই নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করা, যাতে তাদের কোরবানি আল্লাহর কাছে কবুল হয় এবং তা দয়া, ন্যায় ও সংযমের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে। কোরবানির এই শিক্ষা শুধু পশু জবাইয়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা আমাদের মন, নৈতিকতা ও সমাজের প্রতিও গভীর প্রভাব ফেলে।

মোঃ শফিকুল ইসলাম প্রিয়

এই প্রকাশনাটির সর্বস্বত্ত লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত। এই প্রকাশনার আংশিক বা সম্পুণাংশ অন্য যেকোন মিডিয়াতে লেখকের নামে ছাড়া অন্য কারও নামে প্রকাশ করা কপিরাইট আইন এ দন্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গন্য হবে।...

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমুহ

    Recent Comments